উন্নয়ন বনাম গণতন্ত্র-লী থিসিসের বিশ্লেষণ




গণতন্ত্রকে বলা হয় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা। জনগণের নাগরিক অধিকার রক্ষিত হয় বলে এ ব্যবস্থা সবার আদরণীয়। আর এই গণতন্ত্রের দাবিতে দেশে দেশে কত মানুষ যে প্রাণদান করেছে তার লেখাজোকা নেই। প্রফেসর আর জে রামেল অবশ্য গবেষণা করে বের করেছেন,সরকারের হাতে গত শতাব্দীতে সারা বিশ্বে ছাব্বিশ কোটি বিশ লাখ মানুষ মারা গেছেন;আর একনায়কতন্ত্র বা একদলীয় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধেই যে মানুষ উঠে দাড়ায়,তা কে না জানে! ( সংখ্যাটা কতটা ভয়াবহ,তা বোঝার জন্য বলে রাখি, গত শতাব্দীতে সব যুদ্ধ মিলিয়ে মানুষ মরেছে সাড়ে দশ কোটি,সরকার যুদ্ধের চেয়ে মানুষ মেরেছে দ্বিগুণ।)

সাধে কি আর গণতন্ত্র চায় লোকে!

লোকে তো উন্নয়নও চায়,বরং উন্নয়নের দরকার আরো বেশি। পেটেভাতে থাকতে পারলে দেশ কোন গোল্লায় যাবে,কারো চিন্তা হওয়ার কথা নয়। স্বৈরাচারী বা একনায়কদের খুবই প্রিয় একটা লাইন-কম গণতন্ত্র,বেশি উন্নয়ন। অর্থনীতির ভাষায়,উন্নয়ন গণতন্ত্রের সাবস্টিটিউট গুড। মৌলিক অধিকার,রাজনৈতিক স্বাধীনতা,সামাজিক নিরাপত্তা হরণ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করাকে সমর্থন করেন অনেকে। খাতাকলমে এর নাম “লী থিসিস”, সিঙ্গাপুরের একনায়ক লী কুয়ান ইউ এর কার্যক্রম থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এই নামকরণ করা হয়েছে। আসলেই কি এটা সত্যি? উন্নয়ন কি আসলেই গণতন্ত্রের সাবস্টিটিউট?

চলতি অর্থনীতিতে একটা কথা আছে-ইকোনমিক মিরাক্‌ল। কোনো দেশ যদি হঠাৎ করে অনেক উন্নতি করে,অথবা সহসা সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ হয়ে যায়,তখন একে বলা হয় ইকোনমিক মিরাক্‌ল। বিগত শতাব্দীতে অনেকগুলো দেশই এই মিরাক্‌ল বা মুজেজা দেখেছে। ইতিহাস বলে,এই মুজেজা দেখিয়েছে যেসকল পয়গম্বররা,তারা কিন্তু গণতন্ত্রের আশপাশ দিয়েও যান নি!

উনারা বেশিরভাগই একনায়ক,অথবা দেশে ছিল একদলীয় শাসন;গণতন্ত্র ছিল না।বলে রাখা ভালো উনারা গণতান্ত্রিক সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে এসে সিস্টেমকেই বদলে ফেলেছেন!অবশ্য মহাজ্ঞানী প্লাতো বলেই গেছেন-

Dictatorship naturally arises out of democracy,

 and the most aggravated form of tyranny and slavery

 out of the most extreme liberty.

আমরা এখন এই দাবির সত্যতা যাচাই করব। এর আগে আমরা দুটো পয়েন্ট ধরে নেব বিশ্লেষণের জন্য-

১। উন্নয়নের সংজ্ঞা।

২। উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র লাগেনি যেসব দেশে তাদের উন্নয়নের পেছনের কারণ।

উন্নয়ন শব্দটার অর্থ আমাদের কাছে কি পরিষ্কার? সমস্যা হল,আমরা উন্নয়ন হিসেবে বুঝি অবকাঠামোগত উন্নয়ন। কিন্তু উন্নয়নের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে,যেগুলো পূরণ না করা হলে আমরা উন্নয়ন হয়েছে বলে দাবি করতে পারিনা:

১। অবকাঠামোগত উন্নয়ন

২। সাক্ষরতার হার

৩। গড় আয়ু এবং চিকিৎসার সুযোগ

৪। মানবসম্পদ উন্নয়ন

৫। মানবাধিকার

৬। রাজনৈতিক অধিকার

এই ছয়টি জিনিস দিয়েই আমরা আতশকাচের নিচে ফেলব লী থিসিসের সত্যাসত্য। আর কেস স্টাডি হিসেবে নেব কয়েকটি দেশের গল্প,যারা আমাদের দেশের একদলীয় শাসনের স্তাবকদের বড়ই প্রিয়- চীন,জাপান,স্পেন,মালয়েশিয়া,সিঙ্গাপুর ও সুইডেন।

চীন-২০৫০ সালে পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হতে যাওয়া দেশটির প্রবৃদ্ধির হার আশির দশকে ৭.৯% আর এই শতাব্দীর প্রথম শতকে ছিল ৮.৪%। চীনে এক কম্যুনিস্ট পার্টি ছাড়া আর কিছু নেই। মানবাধিকার লঙ্ঘন, নাগরিক অধিকার হনন আর সংখ্যালঘু নিপীড়নে চীনের আশপাশে আর কেউ নেই।

                   চিত্রঃ সাংহাই বন্দর,পৃথিবীর ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দর

চীনের উন্নতির সূচনা হয় ১৯৭৯ সাল থেকে। তখন চীনের উন্নতির পিছে মূল ভূমিকা রেখেছিল তাদের শিক্ষিত দক্ষ মানবসম্পদ। চীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ওপর জোর দিয়েছে।এছাড়া একদলীয় শাসন সত্ত্বেও চীনের আমলাতন্ত্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্র অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং গতিশীল। কমিউনিস্ট পার্টির মাঝে আছে নিয়মতান্ত্রিকতা। শি জিনপিংয়ের হাতে বিপুল ক্ষমতা আসার পূর্বে পার্টি ছিল যথেষ্ট উদার। মিশ্র অর্থনীতি, প্রতিযোগিতামূলক বাজার ও খনিজ সম্পদের বিপুল ভাণ্ডার চীনকে করেছে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ- একদলীয় শাসন নয়।

জাপান– দেশটি সেই ১৯৫৫ সাল থেকে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির অধীনেই আছে এখন পর্যন্ত,মাঝে ১৯৯৩ সালে দশ মাস আর ২০০৯ থেকে ২০১২-এই তিন বছর এলডিপি একটু জিরিয়ে নিয়েছিল।জাপানি অর্থনীতির পাগলা ঘোড়া ছোটা শুরু করেছে এই একটি দলের অধীনে। জাপান পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।

জাপানের এই মিরাকলের পেছনের গল্পটা কিন্তু ভিন্ন,যেখানে একদলীয় শাসনের কোনো ভূমিকাই নেই! জাপানে তকুগাওয়া বংশের শাসন শেষ হয় ১৮৬৫ সালের বিপ্লবে,ক্ষমতায় আসে মেইজি সরকার।দেশে সংস্কার শুরু হয়। তখন থেকেই দেশে আধুনিক শিক্ষা আর স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন শুরু হয়। সেই ক্রমাগত শিক্ষা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের ফলই জাপান লাভ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। জাপান এত দ্রুত উঠে দাঁড়াতে পারে তার দক্ষ মানবসম্পদের জন্য। জাপানের শিক্ষার হার শতভাগ  সাল থেকে। এছাড়াও জাপানে আছে মানবাধিকার ও আইনের শাসন। জাপানিরা ভোগ করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা।


                              চিত্রঃ এলডিপি-এর লোগো;সূত্র- উইকিপিডিয়া

তাহলে জাপানে একদলীয় শাসন কেন চলে?কেন প্রতিটি নির্বাচনে একটাই দল জেতে?

কারণটা সহজ।জাপানিদের চিন্তা,জাপানের সাথে আমেরিকার যে সুসম্পর্ক,তা নষ্ট হবে এলডিপি বাদে অন্য কেউ ক্ষমতায় এলে। আর তাই ফি বছর নির্বাচনে জেতে এলডিপি।

কম গণতন্ত্র নয়,বেশি গণতন্ত্রই জাপানের উন্নয়নের চাবিকাঠি।

স্পেন – ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত সময়টাকে স্প্যানিশরা বলে  El Milagro español , দ্য স্প্যানিশ মিরাক্‌ল। এসময় দেশটির শাসক ছিলেন জেনারেল ফ্রান্সিস্কো ফ্র্যাঙ্কো। ইউরোপের একমাত্র একনায়ক,যিনি ৩৫ বছর শাসন করেছেন একটি দেশকে,ন্যূনতম মানবিকতার ধার না ধেরে।

১৯৬১ সালে স্পেনের জিডিপি গ্রোথ রেট ছিল ১১.৮৪%, ১৯৭৪ তা হয়েছিল ৭.৭৫%। মাথাপিছু জিডিপি ১৯৬০ সালের ৩৯৭ ডলার থেকে আশির দশকে বেড়ে দাঁড়ায় ১০,৮৬৮ ডলারে। স্পেনের সকল শিল্পায়নে শুরু হয় এই সময়ে।

 জেনারেল ফ্র্যাঙ্কো গোঁড়া ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের কানুন জারি করেছিলেন স্পেনে। নিষিদ্ধ ছিল বিবাহ বিচ্ছেদ,জন্মনিয়ন্ত্রণ আর গর্ভপাত, সকল কোর্ট ম্যারেজ অবৈধ ঘোষণা করা হয়, নারীদের কার্যত গৃহবন্দী করা হয়। সশস্ত্র পুলিশ নির্মমভাবে ছাত্রদের দমন করে, রাজনৈতিক বিরোধীদের তুলে গনকবর দেয়া হয় কম্যুনিজম ঠেকানোর নামে। সংস্কৃতির ওপর চলে সেন্সরশিপ,কাতালান আর আন্দালুসিয়ান সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। প্রায় দুই লাখ মানুষের জীবন নেন ফ্র্যাঙ্কো।

এটা আর যাই হোক,উন্নয়ন নয়। এটা অবকাঠামোগত উন্নয়ন। মানবাধিকার হরণ,রাজনৈতিক দাসত্ব এবং ভয়ের সংস্কৃতি চালু করে ফ্র্যাঙ্কো মধ্যযুগে ঠেলে দিয়েছিলেন স্পেনকে। এই উন্নয়ন ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল একটি কারণে,ফ্র্যাঙ্কোর মৃত্যুর পর স্পেনে গণতন্ত্র আনার মধ্যে দিয়ে। নইলে স্পেনের পরিণতি হত লিবিয়ার মত,শক্তিশালী একনায়কের মৃত্যুর পর চরম বিশৃঙ্খলায় পতিত হত দেশটি।

মালয়েশিয়া– আমাদের দেশের কাছে উন্নয়নের এক রোল মডেল। ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মাহাথির মুহাম্মদের আমলে উন্নয়নের চরম পরাকাষ্ঠা দেখায় মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার গ্রোথ রেট ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত এক যুগে একবারো ৯% এর নিচে নামেনি। উনার আমল পুরোটাই ৭% গড় প্রবৃদ্ধি দেখেছে মালয়েশিয়া। ৯০ এর দশকে হরহামেশাই কুয়ালামপুর স্টক এক্সচেঞ্জ ট্রেডিং ভল্যুমে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জকে ছাড়িয়ে যেত। মাহাথির তার ডেপুটি, পুত্রতুল্য আনোয়ার ইব্রাহিমকে হাস্যকর সমকামিতা আর দুর্নীতির দায়ে জেলে ভরেছিলেন টানা নয় বছর;বিচার শেষ হবার আগেই টেলিভিশনে আনোয়ারকে তিনি দোষী সাব্যস্ত করে দেখিয়েছেন মালয় বিচারব্যবস্থা কতটা স্বাধীন; ১৯৮৭ সালে কুখ্যাত অপস লালাং বিক্ষোভের পর ১১৯ জন ছাত্রকে গ্রেফতার, সংবাদপত্রের লাইসেন্স রদ এবং বিরোধীপক্ষ দমনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি অলিখিত কর্তৃত্ববাদী শাসন স্থাপন করেন।মালয়েশিয়া এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর একটা,আর এর জাতির পিতা মাহাথির মুহাম্মদ।

চিত্রঃ মালয়েশিয়ার জিডিপি গ্রোথ রেট এবং ইনফ্লেশন (১৯৫৫-১৯৯৯) সূত্র-রিসার্চগেট।

মালয়েশিয়ার এতটা উন্নতির কারণ কী? মাহাথির মুহাম্মদ তার বিরোধীদের দমন করার পাশাপাশি সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছেন। এছাড়াও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন। এদিক থেকে মাহাথিরকে ডিক্টেটর না বলে বেনেভোলেন্ট মনার্ক বললেও অত্যুক্তি হয় না।

অর্থাৎ, মালয়েশিয়ার উন্নতির পেছনে মূল অবদান একনায়কতন্ত্রের নয়, শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো,দক্ষ জনসম্পদ আর ভৌগোলিক অবস্থান।

দক্ষিণ কোরিয়া– জি-২০ এর এক সদস্য। এশিয়ান টাইগার বলা হয় যে দেশগুলোকে,এর মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ কোরিয়া।এই দেশের মিরাকলকে পশ্চিম জার্মানির “রাইন নদীর মিরাকলের” সাথে মিলিয়ে বলা হয় “হান নদীর মিরাকল”। দক্ষিণ কোরিয়ার সুসময় আসে ষাটের দশকে.১৯৬১ সালে ক্যু দে তা করে ক্ষমতা দখন করেন জেনারেল পার্ক চুং-হে। উনার হাত ধরেই দক্ষিণ কোরিয়া শুরু করে শিল্পায়ন;মাথাপিছু জিডিপি বাড়ে সাড়ে তিনগুণ। এই ডিক্টেটর নাগরিক অধিকার আর গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন, “মোরালিটি ল” জারি করে জনগণের পোশাক-পরিচ্ছেদ,সঙ্গীত,সাহিত্য,চলচ্চিত্রের উপর  কড়া নজরদারি চালান তিনি। মিডিয়া সেন্সরশিপ করেন তিনি কম্যুনিজম ঠেকানোর নাম করে। কোরিয়ান সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এসময় পথেঘাটে ভিন্নমতাবল্মীদের ধরে নিয়ে নির্যাতনের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করে। ১৯৭৯ সালে এই ডিক্টেটর তার সিকিউরিটি চিফের হাতে প্রাণদান করেন। তার মৃত্যুর পরই দ্রুত গণতন্ত্রায়ন হয় দেশটিতে;এখন দেশটি গণতন্ত্রের এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

চিত্রঃ দক্ষিণ কোরিয়ার পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (১৯১০-২০১০) সূত্র-উইকিপিডিয়া

দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রের আমরা একই চিত্র দেখব।বিরোধীদের তুমুল আন্দোলন,প্রতিবাদের বিরুদ্ধে অবকাঠামোগত উন্নয়নকে দাঁড় করিয়েছিলেন পার্ক চুং-হে। এছাড়াও, দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষার হার অত্যন্ত বেশি ছিল; আরো ছিল মুক্তবাজার, সামাজিক পুঁজি আর ভূমি সংস্কার-যা তৈরি করেছে বিনিয়োগের সুযোগ। এমন একটা বাণিজ্যবান্ধক অর্থনীতির জন্যই এসেছিল হান নদীর মিরাকল- পার্ক চুং-হে এর ডিক্টেটরশিপের কোনো কৃতিত্ব এখানে ছিল না।

সিঙ্গাপুর– ১৯৫০ সালে মালয়েশিয়ার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সিঙ্গাপুরে ১৯৫৯ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন লি কুয়ান ইউ। উনার শাসনামলে কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো বছরই জিডিপি গ্রোথ রেট দশের নিচে নামেনি।১৯৯০ এ ক্ষমতা ছাড়ার সময়ও দেশটির জিডিপি গ্রোথ ছিল ৯.৮%। এরই মাঝে দেশটি হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম ট্রেডিং হাব। লিয়ের হাত ধরে দেশটি গড়ে তুলেছে বিশ্বের সেরা শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে মুক্তবাণিজ্যের দেশ, সবচেয়ে ব্যবসাবান্ধব দেশ এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশ।

চিত্রঃ সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি (১৯৭০-২০১০) সূত্র-উইকিপিডিয়া

সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিতে মূল ভূমিকা রেখেছে তার ভৌগোলিক অবস্থান। সিঙ্গাপুর বৈশ্বিক ট্রেডিং হাব।এছাড়াও সিঙ্গাপুরের মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক পুঁজি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর ব্যবসাবান্ধব সরকারের জন্যই সম্ভবপর হয়েছে এই উন্নতি-একনায়কতন্ত্রের জন্য নয়।

সুইডেন- ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় Rekordåren -রেকর্ড ইয়ার্স। এসময় দেশটিতে একদলীয় শাসন চালিয়েছিলেন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট টাগে এর্ল্যান্দে। ছয় ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি এই প্রধানমন্ত্রী একাধারে ২৩ বছর শাসন করেন সুইডেনকে-দৈত্যাকৃতির হওয়ায় তাকে সুইদিশরা ডাকত “ল্যাঙ্গ” বলে। এসময়ে সুইডেনের জিডিপি গ্রোথ বাড়ে ১২.৫% হারে,মাথাপিছু জিডিপি বাড়ে ২০০ গুণ।সুইডেনের জাহাজ নির্মাণ,অটোমোবিল,ইলেক্ট্রনিক্স,অস্ত্র-সকল শিল্পের সূচনা হয় এই আমলে। উনার নেতৃত্বে সুইডেন ১৯৫৫-১৯৫৬ সালেই উচ্চ আয়ের দেশে পৌছে যায়।

সুইডেনের ক্ষেত্রেও আমরা একই দৃশ্য দেখব। দক্ষ জনসম্পদ আর খনিজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার দেশটিকে এগিয়ে দিয়েছে।আইনের শাসন আর মানবাধিকার,উন্নত স্বাস্থ্যসেবা আর রাজনৈতিক অধিকার ছিল দেশটিতে। এছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থান এবং পুঁজির সুষম ব্যবহার দেশটিকে সমৃদ্ধ করেছে।

সুইডেনের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখেনি একনায়কতন্ত্র।

অর্থাৎ,ইকোনমিক মিরাকল ধরে রাখার জন্য মূল ভূমিকা পালন করে-

১। গণতন্ত্রায়ন

২। শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ

৩। মানবাধিকার

৪। শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান

৫। স্বাস্থ্যসেবা

৬। পুঁজির যথাযথ ব্যবস্থাপনা

ওপরের সব কয়টি দেশই এ প্রভাবকগুলোকে ধরে রেখেছে এবং সে কারণেই দেশগুলো উন্নত সমৃদ্ধ দেশ। আর যারা এটা ধরে রাখতে পারেনি,তাদের দেশ অর্থনৈতিক দুরবস্থার কবলে পড়েছে একটি সমৃদ্ধ ইকোনমিক মিরাকলের পর। কয়েকটি উদাহরণ দেই।

ষাটের দশকে সিরিয়ার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.৭%, আর রিয়েল জিডিপি গ্রোথ ছিল ১০.২%। ইরানের ১৯৮০ এর দশকে গড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯% হারে, ১৯৮২ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ২২.৭%,যা সর্বকালের সর্বোচ্চ। ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজের সময় দেশটি বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর  একটি ছিল। লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনামলে লিবিয়ার সমৃদ্ধি তো প্রবাদতুল্য। ইরাকের ইতিহাসে একমাত্র সমৃদ্ধির সময়কাল ছিল সাদ্দাম হুসেইনের আমলে ইরান-ইরাক যুদ্ধের আগে। পাকিস্তানের একনায়ক জিয়াউল হকের আমলে পাকিস্তান এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়,নিউক্লিয়ার রেসে যোগ দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করে আর দ্রুত শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যায়। পিনোশের আমলে শুরু হয় “মিরাকল অব চিলি”,যার প্রশংসা করে গেছেন আমাদের গুরু মাইকেল ফ্রিডম্যান। কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়নে ভ্রান্ত ধারণায় ইন্দিরা গান্ধী ভারতে জারি করেন জরুরি অবস্থা,যার ফলাফল খুব ভালো হয়নি উনার জন্য। এই ধাক্কা ১৯৯১ সালে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রেসে যোগ দেবার সময় মনমোহন সিং-ও অনুভব করেছিলেন।

অর্থাৎ, লী থিসিসের খেই ধরে যারা বলেন,উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রে প্রয়োজন নেই,তারা হয় উন্নয়নের সংজ্ঞা সম্পর্কে জানেন না,অথবা জেনেবুঝে সাধারণ মানুষের অধিকার হরণের পথ তৈরি করার কাজ করেন। লী থিসিস নিয়ে অমর্ত্য সেন বলেছেন,

“This thesis is sometimes backed by some fairly rudimentary empirical evidence. In fact, more comprehensive intercountry comparisons have not provided any confirmation of this thesis,and there is little evidence that authoritarian politics actually helps economic growth.”

তাই,সব শেষে বলা যায়,গণতন্ত্র তথা স্বাধীনতার মাধ্যমে হয়তো নাটকীয় ইকোনমিক বুম হয় না,কিন্তু ধীরে সুস্থে একটা শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে ওঠে।কারণ,সাধারণ জনতা ইতিহাস গড়ে,মুজেজা দেখায় না।ভলতেয়ার তো বলেই গেছেন,

“When dictatorship is a fact, revolution becomes a right.”

অতএব, উন্নয়ন বনাম গণতন্ত্র নয়,গণতন্ত্রায়নই যে টেকসই উন্নয়ন,সেটা প্রমাণিত হল। কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন,এমন শ্লোগানের খপ্পরে পড়ে একনায়কতন্ত্র বা একদলীয় শাসনকে নৈতিক সমর্থন দেয়ার মত ভ্রান্তপথে পা না বাড়ানোই সমীচীন।জনগণের দেশের কল্যাণ জনগণকেই করতে দেয়ার মাঝেই আছে প্রকৃত উন্নয়ন।

সূত্রঃ

Development as Freedom;Sen,Amartya Kumar. Alfred A.Knopf Publications,New York 2000

https://data.worldbank.org/indicator/NY.GDP.MKTP.KD.ZG?locations=IR

https://www.theguardian.com/news/datablog/2012/mar/23/china-gdp-since-1980

https://www.investopedia.com/articles/economics/09/german-economic-miracle.asp

http://countrystudies.us/syria/40.htm

https://en.wikipedia.org/wiki/Economic_miracle

https://www.scmp.com/week-asia/politics/article/2145596/mahathir-malaysian-dictator-who-became-giant-killer

https://www.businessinsider.com/most-succesful-dictators-2011-6

wikipedia.org/wiki/Spanish_miracle#Initiation_of_the_boom

https://en.wikipedia.org/wiki/Operation_Lalang

https://www.ceicdata.com/en/indicator/spain/gdp-per-capita

https://www.researchgate.net/figure/The-GDP-growth-rate-and-inflation-rate-in-Malaysia_fig1_235262052

https://en.wikipedia.org/wiki/Record_years

https://data.worldbank.org/indicator/NY.GDP.MKTP.KD.ZG?locations=SG

https://en.wikipedia.org/wiki/Saddam_Hussein

https://www.brainyquote.com/topics/dictatorship-quotes

Comments