লুসান চুক্তির পথে

 


লুসান চুক্তি নিয়ে আমরা সবাই মোটামুটি জানি। ১৯২৩ সালে হওয়া এই চুক্তির কারণে তুরস্ক ভূমধ্যসাগরে তার সমুদ্রসীমায় খনিজসম্পদ আহরণ থেকে বিরত হয়ে থাকতে হচ্ছে একশো বছরের জন্য। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার অন্যতম পীঠস্থান তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে বহু পুরাতন বিবাদের এক উষ্ণ সময় দেখছি আমরা। কিন্তু লুসান চুক্তি অত্যন্ত নমনীয় একটি চুক্তি, অন্তত কামাল আতাতুর্কের বিপ্লব না হলে অটোমান সালতানাতের সাথে মিত্রশক্তির যে চুক্তি হয়েছিল- তাতে তুরস্কের সার্বভৌমত্বই থাকত না আজ; আর যে বাহুবলের ওপর দাঁড়িয়ে এরদোগান এত ‘পুরনো দিনের গৌরব’ ফিরিয়ে আনতে চাইছেন, তার নামগন্ধও থাকত না। অথচ এরদোগানের আমলে সিস্টেমেটিক কায়দায় এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে কামাল আতাতুর্কের বিপ্লবকে আর তার আগে অটোমান সালতানাতের মেনে নেয়া মিত্রশক্তির তুর্কি পার্টিশন। সেই পার্টিশন আর কামাল আতাতুর্কের বিপ্লবীদের কীর্তি নিয়ে খানিকটা আলাপ থাকবে আমার এই লেখায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পরপরই ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালি একটি জোট গঠন করে- ত্রিপক্ষীয় আঁতাত। এই আঁতাত ১৯১৫ সালেই সিদ্ধান্ত নেয়- তুরস্ককে যুদ্ধে হারিয়ে তারা অটোমান সাম্রাজ্যকে ভাগবাটোয়ারা করে নেবে। এর ধারাবাহিকতায় কুখ্যাত সাইকস-পিকট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যাতে অটোমান সাম্রাজ্যের আরবভূমিকে তিনভাগ করে নেয়া হয়। দক্ষিণে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ব্রিটেন, পশ্চিমে লেবানন আর ভূমধ্যসাগরের তীরভূমি ফ্রান্স এবং পুবে সিরিয়া আর ট্রান্সজর্দান আরবদের হাতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইহুদিদের জন্যও স্বতন্ত্র দেশ তৈরি করে দেয়ার কথা ছিল এতে- ফিলিস্তিনের ব্রিটিশ ম্যান্ডেট থেকে ১৯৪৮ সালে এই কাজটি করে ব্রিটেন।



ওদিকে সাজোনোভ-প্যালেওলগ সমঝোতার মাধ্যমে ফ্রান্স রাশিয়াকে ইস্তাম্বুলসহ অটোমান রুমেলিয়া আর আর্মেনিয়া দিয়ে দেয়। আর ১৯১৫ সালে ফ্রান্সের সেন্ট জাঁ-দ্য-মরেনে’ শহরের এক রেলবগিতে বসে করা সমঝোতার মাধ্যমে ইতালি ভাগে পায় আনাতোলিয়া। আর গ্রিস পশ্চিমাদের সাথে মুলোমুলি করে ইস্তাম্বুল ছাড়া থ্রেস আর আদ্রিয়ানোপোল নেবার সিদ্ধান্ত নেয়।



১৯১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এক অ্যাংলো-ফ্রেঞ্চ মোডাস ভিভেন্দি  চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যার মাধ্যমে সাইকস-পিকট চুক্তি অনুযায়ী তিনটি ‘অধিকৃত শত্রু ভূখন্ড প্রশাসন’ স্থাপন করা হয়। এসময় মসুল আর কিরকুক অঞ্চল কুর্দিদের হাতে না দিয়ে তুর্কিদের হাতেই রাখা হয়, ফলে কুর্দিদের স্বাধীন ভূখণ্ড পাবার আশা নষ্ট হয়ে যায়। এর পিছে উদ্দেশ্য ছিল এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখা, যাতে মধ্যস্থতাকারী আর অস্ত্র বিক্রেতা হিসেবে পশ্চিমা শক্তি লাভবান হয় (এবং ঠিক সেটাই হচ্ছে এতবছর ধরে!)

৩০ অক্টোবর মুদ্রোসের যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে সুলতান ষষ্ঠ মাহমুদের অটোমান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এ চুক্তিতে মিত্রশক্তি অটোমান সাম্রাজ্যকে ভাগ না করার কথা বললেও তলে তলে আরবদের বিদ্রোহে লেলিয়ে দিয়া আর গ্রিকদের সৈন্য জড়ো করতে দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ত্রিশক্তি আঁতাত। আর এর প্রথম ধাপ শুরু হয় ১৩ নভেম্বর এক ব্রিগেড ফ্রেঞ্চ সৈন্য ইস্তাম্বুল অধিগ্রহণ করে। পরদিনই দার্দানেলিস প্রণালিতে ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান আর গ্রিক নৌবহর এসে সৈন্য নামায়।

অটোমান সাম্রাজ্যকে ভাঙ্গার প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯১৯ সালের ১৯ জানুয়ারির প্যারিস শান্তি সম্মেলন থেকে। সে সম্মেলনে আনাতোলিয়ার দখল নিয়ে তুমুল বাগবিতণ্ডা হয় ইতালি আর গ্রিসের মধ্যে, ওয়াক-আউট করে ইতালিয়ান ডেলিগেট। পরে ইতালিকে উত্তর আফ্রিকায় থাকা লিবিয়া আর সাইরেনিকার বদলে আনাতোলিয়া গ্রিসকে ছেড়ে দেয়ার জন্য রাজি করায় ব্রিটেন। গ্রিস ১৫ মে পশ্চিম আনাতোলিয়ার স্মার্না বন্দরে সৈন্য নামায়, সেখান থেকে আনাতোলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে গ্রিক সেনাবাহিনী। ওদিকে ইস্তাম্বুলে সুলতান বা অটোমান পার্লামেন্টের হাতে কোনো শক্তিই নেই। সকল সিদ্ধান্তই হচ্ছিল মিত্রশক্তির ইচ্ছেমত।

তুরস্কের অভ্যন্তরে জাতীয়তাবাদীরা ধীরে ধীরে প্রতিরোধ শুরু করে। জাতীয়তাবাদী অটোমান কর্মকর্তারা কারাকোল জেমিয়েতি (সেন্টনেল অ্যাসোসিয়েশন) নামের এক গুপ্ত সংগঠন গড়ে তোলেন। এর কাজ ছিল যেকোনো ভাবে মিত্রশক্তির ইচ্ছেমত নেয়া সুলতানের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করা। একই সাথে মিত্রশক্তির কাছ থেকে গোপনে সরিয়ে নেয়া হয় বিপুল পরিমাণে অস্ত্র আর গোলাবারুদ; সেগুলো পাচার করে নেয়া হয় মধ্য আনাতোলিয়ায়। বিপ্লবীদের সকল তথ্য গোপন করে রাখেন অটোমান সাম্রাজ্যের জাতীয়তাবাদী কর্মকর্তারা। আর এই গুপ্তচক্রের সাথে যোগ দেন অটোমান ওয়ার-হিরো মুস্তাফা কামাল পাশা।

কামাল পাশা ছিলেন অটোমান নাইনথ আর্মির ট্রুপ ইন্সপেক্টর। তাকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয় ৩০ এপ্রিল। সেখান থেকে বিপ্লবীদের সাহায্যে গোটা আনাতোলিয়ায় থাকা সকল সেনা ইউনিটের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। একইসাথে আলি ফুয়াদ পাশা আঙ্কারায় সরিয়ে নিয়ে আসেন অটোমান টুয়েন্টিথ কোরের সৈন্যদের; সির্কাশিয়ানদের নিয়ে গঠন করা হয় গেরিলা সংগঠন।

১৬ এপ্রিল স্মার্নায় অবতরণ করা গ্রিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করার লক্ষ্যে কিছু বিশ্বস্ত বিপ্লবী কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে কামাল পাশা এসএস বান্দির্মা নামক এক পুরনো স্টিমারে চড়ে চলে যান সামসুনে। ১৯ তারিখে সামসুনে পৌঁছে স্থানীয় মিনিৎকা প্যালেস হোটেলে নিজেদের ঘাঁটি স্থাপন করেন তিনি। এরপর জনসাধারণকে গ্রিকদের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলতে শুরু করেন। একই সাথে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের সাথে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করেন তিনি। এক সপ্তাহ পর সামসুন থেকে ৮৫ কিলোমিটার পুবে হাভজায় চলে যান বিপ্লবীরা।

২১ জুন কামাল পাশা অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতা রউফ বে, আলি ফুয়াদ পাশা আর রেফেত বে এর সাথে মিলিত হন। পরদিন ঘোষণা করা হয় আমাসিয়া সার্কুলার। এই সার্কুলারে ব্রিটিশ ও গ্রিক সৈন্যদের কাছ থেকে তুরস্কের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের ডাক দেয়া হয়। একই সাথে ইস্তাম্বুলের অটোমান সরকারকে পশ্চিমাশক্তির পুতুল বলে ঘোষণা দেয়া হয়।

২ জুলাই সুলতান কামাল পাশাকে টেলিগ্রাম পাঠান, নির্দেশ দেন ইস্তাম্বুলে ফিরতে। কিন্তু কামাল পাশা তা অমান্য  করেন, কারণ তিনি জানতেন ইস্তাম্বুলে ফিরলে পশ্চিমারা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। জুলাইয়ে এরজুরাম আর সেপ্টেম্বরে সিভাস শহরে কাউন্সিল হবার পর গঠিত হয় তুর্কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।

ডিসেম্বরে অটোমান পার্লামেন্টের শেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আলি রেজা পাশা সরকার গঠন করেন। তিনি ভেবেছিলেন অটোমান সরকার আর তুর্কি বিপ্লবীদের মাঝে সমঝোতা আনতে পারবে এ পার্লামেন্ট। কিন্তু এ পার্লামেন্ট ইস্তাম্বুলে থাকা ব্রিটিশ ব্যাটালিয়নের পাপেটে পরিণত হয়। প্রতিটি কাগজে আলি রেজা পাশার সাথে সাথে ব্রিটিশ সেনাকর্মকর্তার সই থাকত। সকল সিদ্ধান্তই নেয়া হত ব্রিটিশদের মর্জিমত।

ব্রিটিশরা আনাতোলিয়ার খ্রিস্টানদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে বিপ্লবীদের শক্তি খর্ব করার পন্থা অবলম্বন করে। কিন্তু আরবদের দিয়ে যে কাজ হাসিল করতে পেরেছিল ব্রিটিশরা, সেটা এখানে সম্ভব হয় না। আরব বিদ্রোহ থেকে শিক্ষা নেয়া বিপ্লবীর এখানে ঐক্যবদ্ধ থাকে।

১৯২০ সালের ১৫ মার্চ রাতে ব্রিটশ সৈন্যরা ইস্তাম্বুলের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখল করে নেয়। সুলতান পরিণত হন ব্রিটিশ পাপেটে। সুলতান জাতীয়তাবাদীদের দুর্বল করার জন্য শায়খুল ইসলামকে নিয়ে বিপ্লবীদের কাফের আখ্যা দিয়ে ফতোয়া দেন। একই সাথে ফতোয়া দেয়া হয়- প্রকৃত মুসলমানরা কখনোই জাতীয়তাবাদীদের সাথে যুক্ত হতে পারেনা (কিন্তু পশ্চিমা শক্তির তাঁবেদার হতে পারে!। বিপ্লবীদের মৃত্যুদণ্ড দেবার ফতোয়াও দেয়া হয়।

মুস্তাফা কামাল জানতেন মিত্রশক্তি এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে। এজন্য তিনি আগেভাগেই পালটা ফতোয়া করিয়ে নিয়েছিলেন আঙ্কারার মুফতিকে দিয়ে- যেখানে সুলতানকে পশ্চিমা প্রভাবাধীন পাপেট বলা হয়েছিল। কামাল আঙ্কারায় কমিটি অব রিপ্রেজেন্টেশন গঠন করেন। তিনি এ কমিটিকেই তুর্কিদের একমাত্র আইনসঙ্গত মুখপাত্র হিসেবে ঘোষণা করেন। ততদিনে সুলতান পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়েছেন, কারণ পার্লামেন্ট নিজেদের মত করে চলতে শুরু করেছিল যা ব্রিটিশদের পছন্দ হচ্ছিল না। পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার পর ব্রিটিশ সৈন্যরা পার্লামেন্ট মেম্বারদের গ্রেফতার করতে শুরু করে। ১০০ জন মেম্বার আর ১৯০ জন ডেপুটি মেম্বার পালিয়ে আঙ্কারায় এসে পৌঁছান। এর মধ্যে ছিলেন চেম্বার অব ডেপুটিজ-এর প্রেসিডেন্ট জেলালেদ্দীন আরিফ। পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা না ব্রিটিশদের ছিল, না ছিল সুলতানের। সুলতাম আবদুল হামিদ ১৮৭৯ সালে পার্লামেন্ট ভেঙে দেবার পর ১৯০৯ সালের সংবিধানে সুলতানের হাত থেকে এ ক্ষমতা সরিয়ে নেয়া হয়। সুলতানের এসব পদক্ষেপ দেশবাসীকে তার অক্ষমতা বুঝিয়ে দেয়। তারা দলে দলে কামালের দলে এসে ভিড়ে। ১৯২০ সালের মার্চে গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি (জিএনএ) গঠন করেন কামাল।

আগস্টের ১০ তারিখ ফ্রান্সের সার্ভে শহরের পোর্সেলিন কারখানায় বসে মিত্রশক্তি আর অটোমান সুলতানের মধ্যে সাক্ষরিত হয় সার্ভে চুক্তি। গ্র্যান্ড উজির দামাদ ফেরিদ পাশার নেতৃত্বে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে  অটোমান সালতানাত। সুলতান ষষ্ঠ মাহমুদ তাকে এ ক্ষমতা দান করেন। এ চুক্তিতে তুরস্কের সীমানা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে কেবল তুর্কি অঞ্চলে- মনে রাখতে হবে সে আমলে পশ্চিম আনাতোলিয়ায় সংখ্যাগুরু ছিল গ্রিক, দক্ষিণে আরব আর কুর্দি এবং পুবে আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠী। এছাড়াও এজিয়ান সাগরের সব দ্বীপ, থ্রেস আর পশ্চিম আনাতোলিয়া গ্রিস নিয়ে নেয়। অটোমান ব্যাঙ্কের সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে নেয় ফ্রান্স, ১৮৫৪ সালের ক্রিমিয়া যুদ্ধের সময়কার সমস্ত ঋণ শোধ করার জন্য বিপুল অর্থ দাবি করা হয়। এছাড়া অটোমান সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ৫০,৭০০ জন, নৌবাহিনীতে ছয়টি হালকা নৌযান ছাড়া আর কোনো অস্ত্র না রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। কোনো বিমানবাহিনী রাখার অনুমতি দেয়া হয়নি অটোমান সাম্রাজ্যকে। ভার্সেই চুক্তির সময় জার্মানির ওপর যা অবিচার করা হয়েছিল, সার্ভে চুক্তি ছিল তার চাইতে বহুগুণে খারাপ।



জিএনএ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী চারজন তুর্কির নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়। একইসাথে ১৯২১ সালের শুরুতে নতুন সংবিধান দেয়া হয়, যাতে তুরস্কের সার্বভৌমত্ব রক্ষার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়। ফেরিদ পাশাকে সরিয়ে আহমদ তেফভিক পাশাকে গ্র্যান্ড উজির বানানো হয়। কিন্তু তিনি সার্ভে চুক্তির অনুমোদন দিতে টালবাহানা করে জাতীয়তাবাদীদের সুযোগ করে দেন। ওদিকে আরবদের দেয়া প্রতিশ্রুতির খেলাফ করে মিশর, ইরাক আর ফিলিস্তিন ব্রিটেন এবং সিরিয়া, লেবানন, জর্দান ফ্রান্সের দখল করে নেয়ায় ক্ষিপ্ত আরবেরা বিদ্রোহ করে। মসুল আর বাগদাদে আক্রান্ত হয় ব্রিটিশ সৈন্যরা। ওদিকে কুর্দিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন নস্যাৎ হয়ে যাওয়ায় তাদের সমর্থন হারায় পশ্চিমা শক্তিরা।

সুলতান চার হাজার সৈন্যের এক খিলাফত বাহিনী গঠন করেন। এর কাজ ছিল জাতীয়তাবাদীদের নিধন করা। একই সাথে দুই ব্যাটালিয়ন ব্রিটিশ সৈন্য ছিল স্মার্নাতে। তারা একযোগে জাতীয়তাবাদীদের ওপর আক্রমণ চালায় ১৯২১ সালের ১৪ জুন। কিন্তু খিলাফত বাহিনীর বিরাট অংশ পক্ষত্যাগ করে, যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে হেরে যায় ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ সরকার হিসেব করে দেখেন, তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের পরাস্ত করতে ২৭ ডিভিশন সৈন্য লাগবে। মাত্রই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, এখন আরেকটা যুদ্ধে জড়ানো কখনোই ব্রিটিশ জনগণ মেনে নেবে না, আর নিয়মিত বাহিনীতে এত সৈন্যও নেই ব্রিটেনের। তাই তারা গ্রিকদের উস্কে দিল জাতীয়তাবাদীদের দমন করার জন্য। বিপুল পরিমাণ গ্রিক সৈন্য উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আগ্রাসন শুরু করল।

 

দক্ষিণে প্রথম সঙ্ঘাত শুরু হয় ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনীর সাথে। ১৯১৮ সালের ১৭ নভেম্বর ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিয়নের ১৫০০০ সৈন্য মারসিনে অবতরণ করে। এরা সবাই ছিল আর্মেনিয়ান, সাথে ১৫০  ফ্রেঞ্চ অফিসার। সেখান থেকে তুরস্কের আন্তেপ, উর্ফা আর মারাশ প্রদেশ দখল করে নেয় ফ্রেঞ্চ বাহিনী। ১৯২০ সালের শীতের শুরুতে জিএনএ আক্রমণ করে মারাশ। তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম লড়াই হয় মারাশে। ফ্রেঞ্চ বাহিনী পিছু হটে যায়। এরপর ১৯২১ সালের মধ্যে তুর্কিরা ফ্রেঞ্চদের দখল করা সব অঞ্চল মুক্ত করে। ২০ অক্টোবর আঙ্কারার চুক্তির মাধ্যমে তুর্কিরা সিরিয়া ছাড়া দক্ষিণের অন্যান্য অঞ্চল রক্ষা করতে সক্ষম হয়। এর মাধ্যমে গঠিত হয় ফ্রেঞ্চ ম্যান্ডেট অব সিরিয়া।

পুবে ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরে আর্মেনিয়ান সেনাবাহিনী আগ্রাসন চালায়। কামাল পাশা লেনিনের সাথে যোগাযোগ করেন। লেনিন তুর্কিদের সহায়তা করতে রাজি হন, কারণ এতে রাশিয়ান সিভিল ওয়ারে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে জারপন্থীদের জন্য পশ্চিমা শক্তির সাহায্য কমে যাবে- তারা ব্যস্ত থাকবে তুরস্কে। মস্কো চুক্তির মাধ্যমে লেনিনের সাথে সমঝোতায় আসে তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা। বলশেভিকরা তুর্কিদের অস্ত্র ও অর্থসাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে তা আসতে আসতে ১৯২২ সাল হয়ে যায়।

১৩ সেপ্টেম্বর জেনারেল কাজিম কারাবেকির আর্মেনিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। নভেম্বরের মধ্যে তুর্কিরা আর্মেনিয়ানদের পিছু হটিয়ে দেয়। ডিসেম্বরের ৩ তারিখে আলেক্সান্দ্রোপোলের চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক- আর্মেনিয়ান সীমানা নির্ধারিত হয়।  ওদিকে ২৯ নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন আর্মেনিয়ায় আগ্রাসন শুরু করে আর্মেনিয়াকে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকে পরিণত করে। এরপর সোভিয়েত ইউনয়নের সাথে কামাল পাশা কারসের চুক্তি স্বাক্ষর করেন ১৯২১ সালের ১৩ অক্টোবর। অটোমান নাকচিভান আর বাটুমি প্রদেশ সোভিয়েত রাশিয়াকে দেয়ার বিনিময়ে ৩৯ হাজার রাইফেল, ৩২৭ মেশিনগান, ৫৪টা কামান, ২০০ কেজি স্বর্ণ আর এক কোটি তুর্কি লিরা দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।



প্রাচীন গৌরব পুনরুদ্ধার করেন গ্রিক মহারাজ্য তৈরির স্বপ্নে বিভোর গ্রিক সেনাবাহিনী তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই আঙ্কারার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে যায়। আঙ্কারায় ভিক্টরি ডিনার করার আমন্ত্রণ জানানো হয় ব্রিটিশ অফিসারদের। উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত গ্রিক সেনাবাহিনীকে তৎকালীন ব্রিটিশ পর্যবেক্ষকগণ বলতেন- পৃথিবীর অন্যতম দক্ষ সেনাবাহিনী। অন্যদিকে তুর্কি বাহিনীর হাতে ছিল না প্রয়োজনীয় অস্ত্র বা পোশাক। প্রতিটি বাড়ি থেকে একজোড়া স্যান্ডেল আর একটা প্যান্ট নিয়ে সজ্জিত করা হয় তুর্কি বাহিনীকে। অথচ এই ভাঙাচোরা বাহিনীই গ্রিকদের শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করে সাখারিয়ার যুদ্ধে। উন্নত যুদ্ধকৌশল আর দৃঢ় মনোবলের মাধ্যমে ক্ষুদ্র তুর্কি বাহিনী গ্রিকদের হটিয়ে দেয়।



২৬ আগস্ট তুর্কি বাহিনী কাউন্টার অফেন্সিভ শুরু করে। একে একে গ্রিক ঘাঁটি দখল করে নেয় তারা। ৩০ আগস্ট দুমলুপিনার যুদ্ধে তুর্কি বাহিনী গ্রিকদের আবারো হারিয়ে দেয়। এ দিনটি তুরস্কের বিজয় দিবস হিসেবে এখনো পালিত হয় প্রতিবছর। ৯ সেপ্টেম্বর প্রায় তিনবছর দখলে রাখা স্মার্না থেকে বিতাড়িত হয় গ্রিক বাহিনী। এর মাধ্যমেই তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা রক্ষা করে তুরস্কের সার্বভৌমত্ব।

কামাল পাশার বিজয় মিত্রশক্তিকে আবারো আলোচনায় বসতে বাধ্য করে। ১৯২২ সালের ৩ অক্টোবর মারমারা সাগরের তীরে মুন্দানিয়ায় এক যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হয়। ব্রিটিশরা ভয় পাচ্ছিল জিএনএ সেনাবাহিনী ইস্তাম্বুলে আক্রমণ করে নাকি। কিন্তু ব্রিটিশ বাহিনীকে সরিয়ে নেয়ার জন্য দার্দানেলিসে সেফ প্যাসেজ করে দেন কামাল পাশা। গ্রিক বাহিনী মারিৎজা নদীর পশ্চিম পাড়ে সরে যায়। পূর্ব থ্রেস আর সমগ্র আনাতোলিয়া দখলে নেয় তুর্কিরা। এসময়কার বর্ণ্না খুব সুন্দরভাবে তুলে এনেছেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তার ইন আওয়ার টাইম বইয়ে। তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। তার পোস্টিং সে সময় ছিল থ্রেসে।

১৯২২ সালের ১ নভেম্বর অটোমান সালতালাত বিলোপ করা হয়। ১৭ নভেম্বর ব্রিটিশ জাহাজে করে ব্রিটিশ দ্বীপ মাল্টায় চলে যান সুলতান। এককালের পরাক্রান্ত অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান তার সময়টা এভাবে ব্রিটিশদের ছায়ায় কাটিয়েছেন।

২১ নভেম্বর সুইটজারল্যান্ডের লুসানে  শুরু হয় সম্মেলন। এখানে ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই দীর্ঘ দর-কষাকষির পর স্বাক্ষরিত হয় লুসান চুক্তি। এর দশ সপ্তাহের মধ্যে তুরস্কের মাটি থেকে মিত্রশক্তি তাদের সৈন্য সরিয়ে নেয়। শুরু হয় আধুনিক তুরস্কের যাত্রা।



এখন ইতিহাসের এই সময়ে এসে আমরা যেন ভুলে না যাই, এরদোগান আর তার অটোমান গর্বে উদ্দীপ্ত অ্যাপোলজিস্টরা যে তুরস্কের মাটিতে দাঁড়িয়ে কামাল পাশা আর তুর্কি বিপ্লবীদের সমালোচনা করছেন, সেই মাটির প্রতিটি ইঞ্চিতে লেখা আছে কাদের রক্তে অর্জিত এই তুরস্ক, যার মাটিতে দাঁড়িয়ে আজ প্রাচীন গর্বের মদমত্ত তারা। এরদোগান যে আজ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট, সে তুরস্কের সাইজ হত আজ আধুনিক তুরস্কের চারভাগের একভাগ- বা তারও কম। এই তুরস্ক তারা পেয়েছেন সেসকল বিপ্লবীদের রক্তে, যাদের অটোমান সুলতান আর তার অনুগত মোল্লাতন্ত্র কাফের বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

নয়তো ইতিহাস ফিরে আসতে পারে যেকোনো সময়।

 

 

Source:

1.     Jelavich, Barbara (1983). History of the Balkans: Twentieth century

2.     Patrick Balfour, 3rd Baron Kinross. Ottoman Centuries

3.     Palmer, Alan. The Decline and Fall of Ottoman Empire

4.     William Hale: Turkish Foreign Policy

5.     Harry J. Psomiades, The Eastern Question, the Last Phase: a study in Greek-Turkish diplomacy 

6.     http://dergiler.ankara.edu.tr/dergiler/44/671/8544.pdf

7.     https://tcf.org/content/report/turkeys-troubled-experiment-secularism/

8.     https://graphics.wsj.com/100-legacies-from-world-war-1/secular-turkey

Comments