কাশ্মির-জলরাজনীতির রঙ্গভূমি

কাশ্মির- ভূস্বর্গ নামে পরিচিত ৩৪৫৭৪৮ বর্গ কিলোমিটারের এক ভূখণ্ড,যা তিনভাগ হয়ে আছে তিন পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত,পাকিস্তান আর চীনের মাঝে।পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর একটি এই কাশ্মির একইসাথে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তপ্ত জায়গাগুলোর একটিও বটে.গত ত্রিশ বছরে ২০৮৭ জন ভারতীয় সেনাসদস্য এবং কম করে হলেও ২২ হাজার কাশ্মিরি মৃত্যুবরণ করেছে,যদিও বেসরকারি সূত্রে এ সংখ্যা এক লাখের কম নয়। দেশবিভাগের সবচেয়ে বড় কন্ট্রোভার্সিগুলোর একটি এই কাশ্মির ইস্যু এখনো তাতিয়ে রেখেছে উপমহাদেশ।১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রক্সি ওয়ারের চেষ্টা কাশ্মিরে ভারতীয় দখলদারিত্বের সূচনা করে।এরপর ১৯৪৭,১৯৬৫ এবং ১৯৯৯ সালে তিন তিনটি যুদ্ধ হয় কাশ্মির নিয়ে; কাশ্মির হয় দুই ভাগ- জম্মু-কাশ্মির যায় ভারতে,আজাদ কাশ্মির- গিলগিটবাল্টিস্তান পাকিস্তানে।মাঝে ১৯৬২ সালে চীন এক খণ্ড কাশ্মির নিয়ে যায়,ফলাফল-জল আরো ঘোলা হওয়া।

কিন্তু,কাশ্মিরকে কেন চায় ভারত? আর কেনই বা পাকিস্তান ছলে-বলে-কৌশলে কাশ্মিরকে দখল করতে চায়?এটা কি কাশ্মিরের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের জন্যই কেবল,না আরো কোনো ইস্যু আছে এতে?

কাশ্মির ইস্যু হল একটা জিরো-সাম গেম।গেম থিওরি মোতাবেক,এখানে আছে দুই খেলোয়াড়-ভারত ও পাকিস্তান।এখন,ইউরেশিয়া রিভিউ আর্টিকেলে মি. সুব্রত কুমার মিত্র পুলাওয়ামা ইন্সিডেন্টের পর একটি গেম দেখিয়েছিলেন।এতে দেখা যায়,ভারত পাকিস্তান দুপক্ষই শান্তি পছন্দ করলে,তারা ৮ ইউনিট পে-অফ পাবে।কিন্তু কোনো একপক্ষ যুদ্ধ ঘোষণা করলে,সে পক্ষ পাবে ১০ পে-অফ,তথা কাশ্মিরের সম্পূর্ণ দখল আর অপর পক্ষের ভাগে গোল আলু। আবার দুই পক্ষই যুদ্ধের নিয়ত করলে,পাবে ৪ ইউনিট পে-অফ,তথা কাশ্মিরের আংশিক দখল।এখন,যেহেতু দুপক্ষই র‍্যাশনাল( আসলেই কি তাই?) সেজন্যই ০ ইউনিট আর ৪ ইউনিটের মাঝে তারা ৪ ইউনিট তথা যুদ্ধের নিয়ত করে বসে আছে।যদিও দুপক্ষ শান্ত থাকলে ৮ ইউনিট করে পেত,কিন্তু তারা কেউই তা করবে না; কারণ এখানে কেউই একে অপরকে বিশ্বাস করে না-প্রিজনার্স ডিলেমার উপমহাদেশীয় ভার্সন আর কী!

কাশ্মিরকে নিয়ে আজ থেকে ৭০ বছর আগে যে ছকই কষুক না কেন ভারত-পাকিস্তান,এখন কাশ্মিরের গুরুত্ব দুদেশের কাছেই বেড়েছে আরো শতগুণ।আর তার মূল কারণ আর কিছুই না-সপ্তসিন্ধুর পানি।এই পানিই কাশ্মিরের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ,আর বোঝার উপর শাকের আঁটির মত বেদনা বাড়িয়েছে কাশ্মিরিদের।

কাশ্মিরে আছে অসংখ্য হিমবাহ,যা হিমালয়ের বরফগলা পানি নামিয়ে আনে কাশ্মিরের শীতল বুকে।এখন এসকল স্রোতস্বতী নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত প্রায় ১০০ কোটি মানুষের জন্য জলবিদ্যুতের ব্যবস্থা করছে,সাথে হিমবাহের বিশুদ্ধ পানিতে মিটছে সুপেয় পানির চাহিদা।আর পাকিস্তানের মরুময় অঞ্চলের কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখার অক্সিজেন-এই হিমবাহের পানি।আর যেহেতু পানির অপর নাম জীবন,সেহেতু পানির জন্য ‘খুনসে বদলাই’ নিতে ভারত পাকিস্তান কেউই ‘কসুর’ করবে না।

৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬০।

করাচিতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ‘সিন্ধুনদ পানিচুক্তি’।পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু আর আইয়ুব খানের মাঝে স্বাক্ষরিত এ চুক্তিতেই লুকিয়ে ছিল এক ভয়াবহ লুপহোল,যা আজকের কাশ্মির ইস্যুকে করে তুলেছে আরো ভয়াবহ,আরো জটিল।

চুক্তি মোতাবেক পূর্বাঞ্চলীয় তিনটি নদী-বিপাশা( বিয়াস),রাভি আর শতদ্রু(সুতলেজ) নদীর হিস্যা লাভ করে ভারত,আর পশ্চিমাঞ্চলীয় তিনটি নদী- সিন্ধু,ঝিলম আর চেনাবের হিস্যা পায় পাকিস্তান।

চুক্তিটি বিশ্বের পানিবণ্টনের এক সফল উদাহরণ হয়ে থাকলেও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এই যুগে চুক্তিটির একটি ধারা পুরো পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলেছে।নদীগুলো থেকে পানি বেশি পায় পাকিস্তান,যদিও সবক’টি নদীই গেছে ভারতের বুক চিরে।এজন্য নদীতে বাঁধ দেয়া,জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সেচকাজে ব্যবহারে বিশেষ সুবিধে পায় ভারত।পশ্চিমের নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একচ্ছত্র অধিকার লাভ করে ভারত,সাথে পায় সেচের জন্য যথেচ্ছ পানি ব্যবহারের সুবিধে।ভারত এই সুবিধের ষোল আনা ভোগ করা শুরু করেছে।বর্তমানে ভারত পশ্চিমের তিনটি নদী থেকে ৩২৬৩.৪৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।আরো চারটি বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে দহ,হনু,পার্নাই আর নিম্ন কালনাইতে। চেনাব ভ্যালি পাওয়ার প্রজেক্টকে দেয়া হয়েছে আরো নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের কাজ- ১০০০ মেগাওয়াটের পাকাল দুল, ৬২৪ মেগাওয়াটের কিরু আর ৫৪০ মেগাওয়াটের কাওয়ার।

Hydro-power

সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের ডেপুটি চিফ মিনিস্টার নির্মল সিং লোকসভায় বিজেপির বিক্রম রণোধাওয়ার এক প্রশ্নের জবাবে জানান,কাশ্মিরে আরো ১৬৪৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।চেনাব হতে ১১২৮৩,ঝিলম হতে ৩০৮৪ আর সিন্ধু হতে ১৬০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

পাকিস্তানও বসে নেই।তারাও ৪৫০০ মেগাওয়াটের দিয়ামের-ভাশা ড্যাম, ৩৬০০ মেগাওয়াটের কালাবাগ ড্যাম,৬০০ মেগাওয়াটের আখোরি ড্যামসহ আরো অনেক ডয়াম বানিয়ে বিশাল বিশাল ওয়াটার রিজার্ভয়ার বানিয়েছে।

এখন,গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।হিমালয়ের হিমবাহগুলো ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে ১৭৪ গিগাটন ( ১৭ হাজার ৪০০ কোটি টন) পানি।এর ফলে পাকিস্তান আর ভারতে বন্যা দেখা দিয়েছে।

এখন,কাশ্মিরের জল-রাজনীতিতে পাকিস্তানের মাথাব্যথা প্রধানত চারটে।

নাম্বার এক- সিন্ধু পানিচুক্তির পানি ভারত আগ্রাসীভাবে ব্যবহার করছে।ভারত তার ভাগের ৯৫% পানি টেনে নিচ্ছে,ফলে পাকিস্তানের ভাগে পানি যাচ্ছে কম।

নাম্বার দুই-তাদের ভাগে পড়া তিনটে নদীতেই ভারত বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।

নাম্বার তিন-যেকোনো দুর্ঘটনায় ভারতের পানিতে ভেসে যাবে পাকিস্তানের নিম্নাঞ্চল।

নাম্বার চার- পাকিস্তানের সিন্ধু পানিচুক্তির আওতায় পড়ে এমন যেকোনো অবকাঠামো ‘ আইনগত ‘ ভাবে ভারত ধ্বংস করে দেয়ার অধিকার রাখে।

শেষ পয়েন্টটাই চুক্তির মেজর লুপহোল।যেহেতু সিন্ধু অববাহিকার সেচ,জলবিদ্যুৎ এবং ড্যামের অধিকার একচ্ছত্রভাবে ভারতের,সেহেতু পাকিস্তানের এমন যেকোনো অবকাঠামো ধ্বংস করতে পারে ভারত।কিন্তু,পাকিস্তান তা করতে পারবে না।পাকিস্তান আর যাই হোক,এত বড় হুমকির মাঝে থাকতে পারবে না। ভারত কিন্তু এমন কাজ করেছেও আগে।১৯৭১ সালে আজাদ কাশ্মিরের মাংলা ড্যাম ধ্বংস করে দেয় ভারত।কাজেই এমন কাউকে পাকিস্তানের পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।কাজেই,কাশ্মির দখলে রাখা যেমন ভারতের প্রয়োজন,তেমনি কাশ্মিরের মালিকানা পাকিস্তানের জন্যও অস্তিত্বের লড়াই বলা চলে।

এখন কাশ্মিরের আজাদীর লড়াই কেবল আর রাজনৈতিক লড়াই নয়;এর সাথে জড়িয়ে গেছে ভারত ও পাকিস্তানের পানি আর বিদ্যুতের মত জরুরি বিষয়ও।কাশ্মির হারালে ভারত হারাবে তার গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ ও পানির উৎস আর কাশ্মির না পেলে পাকিস্তান হারাবে কৃষিখাত আর জাতীয় নিরাপত্তা।কাজেই সামনের দিনগুলোতে কাশ্মির যদি আরো রক্তাক্ত হয়ে ওঠে,তাহলে এতে কেবল রাজনীতিই জড়িয়ে পড়বে না,সাথে জড়িয়ে পড়বে দুইদেশের অস্তিত্ব।

হে জল, তোমার সংস্পর্শে প্রকৃতি এতো নির্মল,

মোরা তোমা হতে পাই শক্তির সম্বল।

তুমি মোদের চিত্তে হর্ষ আনো,

তুমি পরম পূজনীয়।

হে জল,মাতৃসম মোদের দান করো

তোমার পরম পবিত্র তরল,হে মাতৃরূপিণী।

হে জল,তুমি দুর্বলে শক্তি দান করো,

হে জল,প্রাণের উৎসমূল যে তুমি।

(অপাহ শুক্তাম,ঋগবেদ,১০.৯)

Sources:

  1. www.diplomat.com
  2. www.manifestias.com
  3. www.economictimes.com
  4. https://en.wikipedia.org/wiki/Indus_Waters_Treaty
  5. blogs.cornell.edu

(This article was published in Chhoysho Acre news portal. The link is given below.)

http://chhoyshoacre.com/Politics/Article/5eec549869f4f24363fa0af9/?fbclid=IwAR2hy3HETzrNexGxWcni5KHUsIb1SschuTcPP5i_bttZORJfNfMRs5ykBGs

 

Comments