বিদ্রোহের পদাবলী
শেষ বিদ্রোহী
সে ছিল চমৎকার এক তরুণ
দারুণ কবিতা লিখত আর
বলত আকাশের রং লাল।
সে স্বপ্ন দেখত ডানা মেলার মত আকাশ এসে
চুমু খাবে তার ঝাকড়া বাবরি চুলে ।
এক আকাশের নিচে জারুল গাছের তলে বসে
দুচোখ বুজে প্রেয়সীর কণ্ঠে গান শুনবে বলে
সে যুদ্ধে গেছিল।
যুদ্ধ এসেছিল সহসা, বিদ্রোহ এসেছিল ভোরের
প্রথম আলো হয়ে, মৌনী সন্ন্যাসীর মত ভালোবেসেছিল
মরা কার্তিকের শেষ বিকেলের করুণ অরুণ।
জারুল গাছ পাতাশূন্য হলো,
ক্লান্ত যোদ্ধারা আকণ্ঠ পান করল হেমলক
একে একে সবার শিরস্ত্রাণ নেমে এলো
জনশূন্য ঘাঁটি মুড়িয়ে নিল মৃত্যুদূতের পাখা।
তরুণ দাঁড়িয়ে রইল একা, হাতে ছিন্ন শেকল,
চোখ জোড়া তার ঘুম ঘুম করে থেমে গেছে,
দিগন্তের ওপারে কুয়াশায় সে দেখে
তার প্রেয়সী,হাতে রক্তগোলাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
” তোমার ফেরার সময় হয় নি?
আমাকে ছেড়ে গেছ সেই কবে,
আমার ঠিকানায় একটা চিঠিও পাঠাওনি
প্রেমযমুনায় জল যে উছলে পড়ছে তুমি আসবে বলে!”
তরুণ হাসে, একে একে দেউটি নিভেছে
অন্ধকার ঘিরেছে চারপাশ, পরাজয়ের সুবাস
শিউলি ফুলের মত ছেয়ে দিয়েছে
রণভূমির শেষ ঘাটি, থেমে গেছে যুদ্ধের অর্কেস্ট্রা ।
কোনো এক নো ম্যান্স ল্যান্ডে দাড়িয়ে শেষবারের মত
ভায়োলেন্সের ভায়োলিন বাজায় যান্ত্রিক তরুণ, ফুসফুস নিংড়ে
জান্তব চিতকার করে বিশ্বকে জানান দেয়, সে আছে।
মুখ থুবড়ে ভীষ্মের শরশয্যায় যাবার আগে শেষবার সে
ডাকে তার প্রিয়তমার অলিখিত ডাকনাম।
শত্রু এসে দাড়ায় তার লাশের পাশে, টুপি খুলে তারা
অস্ত্র নামিয়ে শেষ বিদ্রোহীর দিকে তাকিয়ে
শ্রদ্ধায় ভিজে আসে তাদের পাথুরে চোখ।
” ওকে কবর দিও ওই আধপোড়া জারুল গাছের নিচে
যে গাছের বেগুনি ছায়ার নিচে
প্রেয়সীকে নির্ভয়ে চুমু খাবে বলে সে প্রাণ দিয়ে গেছে।”
হে যুদ্ধদিনের প্রেমিকা আমার
হে যুদ্ধদিনের প্রেমিকা আমার
আমি তোমাকে চাই।
আমাদের মাঝে যত কাটাতার আর ব্যবধান
মুছে দিয়ে যাক শত জনমের কবিতা আর গান,
আমার শিরার শিরায় প্রচণ্ড দ্রোহ
আমি আজ তোমাকে চাই।
হে যুদ্ধদিনের প্রেমিকা আমার
আমি মৃত্যুতে বিশ্রাম চাই,
আমি সৃষ্টিশীল খুনি যমরাজকে
আলিঙ্গন করে আমার হাড় জুড়োতে চাই।
তোমার সুডৌল বাহু দিয়ে গড়ে তোলো
মায়াজাল, বেঁধে রাখো আমায় শক্ত করে।
আমার দুচোখে তৃষ্ণা, ওই সাগরের জল শুকিয়ে
মরুভূমি হবে যদি আমি বাড়াই হাত।
তোমায় আমি ছোঁব বলে রাইফেল ছুঁয়েছি
আমার জলপাই উর্দির বুকপকেটে রাখা তোমার ফোটোগ্রাফ,
হে যুদ্ধদিনের প্রেমিকা আমার, বিষ ঢালো আরো,
আমি নীলকন্ঠ হতে চাই।
আমি উড়ে যাবো আজ, মোমের পাখা বেঁধে পিঠে
মরিবার হয়েছে আমার সাধ।
হে যুদ্ধদিনের প্রেমিকা আমার,
তোমার তরে মরেই যাব, তুমিই আমার পাপ।
লাল বেলুন ও নবীন কিশোর
আমায় একটা লাল বেলুন দাও,
আর দাও এক নবীন কিশোর,
আমি আমার শতছিন্ন দ্রোহের ইশতেহার
আকাশে উড়িয়ে দিই।
একদিন ভোরের আলোর মত
জানালার ফাঁক দিয়ে আমায় স্নাত করেছিল
বিপ্লবের প্রথম আলোচ্ছটা।
আমি যুদ্ধে গেছিলাম আমার মাংসের বর্ম
গায়ে জড়িয়ে, মাথায় ছিল হাড়ের শিরস্ত্রাণ।
আমি বিপ্লবকে ভালোবেসেছিলাম
কারণ সে ছিল প্রেমিকার মত উষ্ণ,জীবন্ত ;
মিছিলের শ্লোগান ছিল তার কণ্ঠস্বরের মত
গভীর,মন্দ্র আর ছন্দিত বাঙময়।
এখন আমার করোটির মাঝে মগজ ভুনে খায়
সহস্র মৃত্যুদূত, যজ্ঞের আগুনে ঘি ঢেলে
যে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়েছিলাম, তাতে আত্মহত্যা করছি।
আমার লাশের ওপর চক্রাকারে ঘুরছে শকুন
আর তাকে ঘিরে সান্ত্রীদের বেয়নেটের ঝলকানি।
বিপ্লব ভালোবেসে আসেনা।
বিপ্লব প্রেয়সীর নধর গালের মত তুলতুলে
লাল গোলাপ নয়,তাই কোনো এক ফায়ারিং স্কোয়াডে
আমি দাঁড়িয়ে আছি। যে রক্তগোলাপ পলে পলে
ছিনিয়ে নিয়েছে আমায়, সে গোলাপ আমার শার্টে এখন।
আমি আমার হাজার স্বপ্ন পুরে লাল বেলুনটা
তুলে দিতে চাই সেই নবীন কিশোরের হাতে,
সাথে তুলে দেব আমার না পাওয়া সবকটা
মিষ্টি চুমু। আকাশে আকাশে উড়বে আমার
অবিনশ্বর চির-বিদ্রোহী সত্ত্বা আর
কোনো এক গণকবর থেকে এই জন্মের তরে
যমদূতকে হারিয়ে দিয়ে আমি হাসব প্রাণভরে।
Comments
Post a Comment