নভেম্বরের অগ্নিশিখা
১

শাফায়াতের লড়াই
অক্টোবরের শেষাশেষি।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিজের কামরায় বসে আপনমনে ঘটনার জাল বিছিয়ে চলছেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। কিছুক্ষণ আগেই সেনাসদরের এক পিএসও তাকে হুমকি দিয়েছেন, মোশতাক্ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বন্ধ না করলে তার নামে রিপোর্ট করা হবে। হতাশায় মুষড়ে পড়লেন তিনি, দেশটাকে রসাতলেই নিয়ে গেল ফারুক-রশিদ গং।
বঙ্গবন্ধুর খুনিরা দিব্যি বঙ্গভবনে বসে ছড়ি ঘোড়াচ্ছে দেশের ওপর। কারোর কথাই শুনছে না ওরা। কদিন আগে ট্যাঙ্কগুলোকে ক্যান্টনমেন্টে সরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। মুখে যতই তিনি ‘আপহোল্ড দ্য কন্সটিটিউশন’ বলে ছাড় দিচ্ছিলেন খুনিচক্রকে, ভেতরের ভেতরে ততই তার অস্বস্তি বাড়ছিল তার। খুনির দল জিয়াকে সেনাপ্রধান হবার সুযোগ দিলেও, জিয়া এসব জুনিয়র অফিসারকে গিলতে পারছেন না। তাই তিনি ওদের নিয়ন্ত্রণে আনতে এই আদেশ দিয়েছিলেন।
বলা বাহুল্য, আদেশ মানা হয়নি। নিজের এই ক্ষমতাহীনতায় বেশ অসহায় বোধ করছেন সেনাপ্রধান। মুখরক্ষা করতে নির্দেশ প্রত্যাহার করেছিলেন তিনি। শাফায়াত জামিলের কাছে অনুযোগ করেছিলেন তিনি এ বিষয়ে কদিন আগে।
“স্যার, আপনি চিফ, আপনি অর্ডার করলে আমি জোর করে এদের চেইন অফ কমান্ডে আনার চেষ্টা করতে পারি,” বলেছিলেন শাফায়াত জামিল।
কিন্তু জিয়া দোটানায়, ঠিক সাহস করে উঠতে পারছেন না তিনি।
এভাবে সেনাবাহিনীকে চলতে দেয়া যায় না, কিছু করতেই হবে কাউকে। আর সেটা শাফায়াত জামিলের কাঁধেই এসে পড়েছে মনে হচ্ছে। কার কাছে যাওয়া যায়? খালেদ মোশাররফ?
আচার আচরণে রাজকীয় এই মানুষটি কি সাহায্য করবেন? লে. কর্নেল ফারুক তো তার ভাগ্নে! মামার জোরেই তো ছিল ফারুকের সাহসী চলাফেরা। ফারুককে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়ার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন তো খালেদ মোশাররফই। কিন্তু সেনাবাহিনীর এই দুঃসময়ে আর কার কাছে যাওয়া যায়?
ফারুক-রশিদ শাফায়াত জামিলের অধীনস্ত অফিসার। মাত্র কয়েকটা ইউনিট নিয়ে এতবড় অঘটন ঘটানোর পরও এদের বিচার হচ্ছে না, এরাই ছড়ি ঘোরাচ্ছে দেশের ওপর! অসম্ভব, এ মেনে নেয়া যায় না।
আটাশ তারিখ সকাল। সুযোগ চলে এলো অকস্মাৎ। সেনাসদরে শাফায়াত জামিলের দেখা হয়ে গেল খালেদ মোশাররফের সাথে।
“কিছু কী ভাবছো? এরকমভাবে তো দেশ ও আর্মি চলতে পারে না।জিয়া এগিয়ে আসবে না।ডু সামথিং,” খালেদ মোশাররফ সরাসরি প্রস্তাব দিলেন শাফায়াত জামিলকে, ইতোমধ্যেই তার সাথে কথা হয়েছে রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার কাজী নুরুজ্জামানের।
“আপনি দিন তারিখ বলেন, আমি প্রস্তুত,” শাফায়াতের উত্তর।
যাক! কাউকে তো পাওয়া গেল সাথে!
পরেরদিনই রাত এগারোটায় শাফায়াতকে ডাকলেন জিয়াউর রহমান, বললেন,
“ওরা বড় বাড়াবাড়ি করছে। ট্যাঙ্কগুলো থাকাতেতেই ওদের এত ঔদ্ধত্য। তুমি একটা এক্সারসাইজের আয়োজন করে ট্যাঙ্কগুলো সাভারে নিয়ে যাও।“
শাফায়াত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন,” কবে আয়োজন করব?”
“এই জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে।“
শাফায়াত জামিল জিয়াউর রহমানের ওপর যেটুকু আশা রেখেছিলেন, সেটুকুও হারিয়ে ফেললেন। তিনি চাইছেন ইমিডিয়েট অ্যাকশন, আর জিয়া কিনা দুই-তিন মাস পরের কথা বলছেন!
নাহ! একে দিয়ে আর হবে না। যা করার আমাদেরই করতে হবে।
ঠিক করলেন তিনি, জিয়াকে বন্দী করে ফেলবেন তার বাসভবনে। যে মানুষটার সাথে মুক্তিযুদ্ধে একইসাথে যুদ্ধ করেছেন শাফায়াত, যার সাথে রেষারেষির কারণে পদক দেয়ার সময় জেনারেল ওসমানী জেড ফোর্সের প্রতি অবিচার করেছেন-তার বিরুদ্ধে যেতে খারাপই লাগছিল শাফায়াতের।কিন্তু কিছুই করার নেই। জিয়াকে নিয়ে কী করা যায়? খালেদ মোশাররফ নিখাদ ভালো মানুষ, তিনি জিয়াকে মেরে ফেলবেন না। কিন্তু জিয়াকে রেখে একটা অভ্যুত্থান ঘটানো… নাহ, কিছুতেই অস্বস্তি যাচ্ছে না শাফায়াতের। শাফায়াত ঠিক করলেন, ক্ষমতা সংহত করেই জিয়াকে পাঠিয়ে দেবেন জাতিসঙ্ঘে স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে। কিন্তু জিয়াকে রেখেই সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড কি আনতে পারবেন খালেদ মোশাররফ? খালেদ মোশাররফকে বলা হয়েছিল, সেনাপ্রধানকে বন্দী করে এমনটা করাই হবে চেইন অব কমান্ডের লঙ্ঘন। মিসেস খালেদও পইপই করে স্বামীকে বলেছেন, জিয়ার বিরুদ্ধে যেও না।
খালেদ মোশাররফ শুনলেন না।
জিয়া কি বসে আছেন? না। তিনি কেন চুপচাপ? উনার ওপর আরো তিনজন কর্মকর্তা বসিয়ে দিয়েছেন মোশতাক। জেনারেল ওসমানী্কে পাশে রেখেছেন তিনি, তার পরামর্শেই চলছে সব। সেনাপ্রধান হয়েও লাভের লাভ কিচ্ছু হয়নি জিয়ার। সরিয়ে দিতে হবে সব বাধা। কিন্তু কীভাবে? বিদ্রোহী মেজরদের ঠ্যাঙাতে হবে কি? তার পুরনো সহচর লে. কর্নেল এম এ হামিদ তাকে বারবার বললেন কিছু করতে, কিন্তু তিনি কেবলই অপেক্ষায় আছেন।বলছেন,”হামিদ, ওয়েট অ্যান্ড সি।এক মাঘে শীত যায় না।“কিন্তু, কীসের অপেক্ষা? কর্নেল হামিদ যারপরনাই ত্যক্ত জিয়ার ওপর।
জিয়া অপেক্ষায় আছেন তাহেরের।
জিয়ার পুরনো বন্ধু কর্নেল তাহের। সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই জিয়ার সুহৃদ তিনি। একাত্তরেই বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য একটা পরিষদ গঠন করেছিল মেজর ডালিম-নাম সেনা পরিষদ। এই সেনা পরিষদ গুপ্তচক্রের সদস্য ছিলেন জিয়া তাহের দুজনই। ভারতের বুকে বসে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করায় ছিল দুজনেরই প্রবল অনীহা। এ নিয়ে সেক্টর কমান্ডার মিটিং এ প্রস্তাব তুলেছিলেন তাহের,সাথে ছিলেন জিয়া। কিন্তু ওসমানী,খালেদ,সফিউল্লাহের বিরোধিতায় পণ্ড হয়ে যায় সেটা। উলটো তাহেরের ১১ নং সেক্টরকে জেড ফোর্স থেকে সরিয়ে দেন ওসমানী। তবে দেশে মুক্তাঞ্চল স্থাপন ঠিকই করিয়েছিলেন জিয়া- রৌমারীতে ক্যাপ্টেন নুরন্নবীকে দিয়ে আগস্টে মুক্তাঞ্চল স্থাপন করিয়ে বাংলাদেশের প্রথম ডাকঘর স্থাপন করান তিনি।
স্বাধীন দেশে আশাভঙ্গ হয় তাহেরের। সেনাবাহিনীতে থাকাকালেই চৌকস এই কমান্ডোর ছিল মাও সে-তুং এর প্রতি ঝোঁক। জিয়ার বাসভবনে প্রায়ই মাওয়ের বই পাঠাতেন তিনি তার ড্রাইভারের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর শাসনের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হয় তার।চুয়াত্তরের জুনে তিনি যোগ দেন জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনীতে, নিযুক্ত হন ফিল্ড কমান্ডার হিসেবে। বিপ্লবের রোমান্টিসিজমে আচ্ছন্ন হয়ে তাহের বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, জিয়া সেনাপ্রধান হলে তাকে ব্যবহার করে তাহের পারবেন কিছু একটা করতে। জিয়াকে না দিয়ে যখন শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করা হয়,তখন প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন তাহের। ১৯৭৪ সালের একদিন তিনি শফিউল্লাহকে বললেন,
“স্যার, এতদিন তো চিফ থাকলেন, এবার পদটা জিয়াউর রহমানের জন্য ছেড়ে দেন।“
শফিউল্লাহ খেপে যান,” ইউ আর ডাউন ক্যাটেগোরাইজড, সিএমএইচে গিয়ে সসম্মানে মেডিক্যাল বোর্ড-আউট হয়ে যাও বিফোর আই কিক ইউ আউট।“
অপমান করে তাহেরকে বের করে দেন শফিউল্লাহ।
শফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুর কাছে নালিশ দিয়েছিলেন, কদিন বাদেই তাহের সেনাবাহিনী ছেড়ে দেন। কিন্তু তিনি সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেননি। তিনি ঠিকই কথা চালিয়ে গেছেন জিয়ার সাথে, পচাত্তরের খুনি মেজর ডালিমের সাথেও তার যোগাযোগ ছিল। ডালিম বলেছেন, তারা দুজনের লক্ষ্যই ছিল এক, কেবল পদ্ধতি আলাদা।
পনেরো আগস্টের পর জিয়াকে প্রেসিডেন্ট বানানোর জন্য বারবার তিনি ধর্ণা দিয়েছেন ফারুক-রশিদের কাছে। বিনিময়ে বাকশালী চর খুঁজে দেবে জাসদের লোকেরা।
জিয়া জানতেন না এসবের কিছুই। এর প্রমাণ কদিন পরেই পাওয়া যাবে। ফারুক-রশিদ সোজা বলে দিয়েছিল, জিয়াকে সেনাপ্রধানের পদ ছেড়ে সিভিলিয়ান হিসেবে প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে দাঁড়াতে হবে। নইলে সম্ভব না।
তাহের এবং জাসদ ভেবেছিল জিয়াকে সামনে রেখে চীনা স্টাইলে একটা বিপ্লব করতে। এর জন্যই তলে তলে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু জাসদের মধ্যেই এ নিয়ে দেখা দেয় বিভাজন, তাহেরের পাশে এসে দাঁড়াননি সর্বহারা পার্টিতে সিরাজ শিকদারের উত্তরসূরি লে. কর্নেল জিয়াউদ্দীনও। তেসরা নভেম্বরের বিপ্লবে তাই তাহের বা গ্ণবাহিনী কেউই জিয়ার পাশে আসেননি। কিন্তু জিয়া ঠিকই নিজের পথ করে নিয়েছিলেন, এই উচ্চাভিলাষী ক্যারিশমাটিক মানুষের সামনে ইতিহাসই এনে দিয়েছিল সুবর্ণসুযোগ।
২
জিয়াউদ্দীনের ভবিষ্যৎবাণী
জিয়াউদ্দীন আহমেদ- মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে দক্ষ ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন এই মানুষটা।
দেশটাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন এই মানুষটা, আপাদমস্তক বিপ্লবী জিয়াউদ্দীনের সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রথম মুক্তাঞ্চল সৃষ্টিকারী কমান্ডার ক্যাপ্টেন নুরন্নবী বলেছেন, “মেজর জিয়াউদ্দীনের পরিশ্রম ও দেশপ্রেমের কাছে নিজেকে খুব লজ্জিত মনে হত আমার।“
স্বাধীনতার পর ঢাকা ৪৬ বিগ্রেডের কমান্ডার নিযুক্ত হন তিনি।
১৯৭২ সালের ২০ আগস্ট ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডের প্রথম পাতায় জিয়াউদ্দীন প্রবলভাবে সরকারের সমালোচনা করে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন- দ্য হিডেন প্রাইজ অব ফ্রিডম ফাইটার্স । এটা সেসময় তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। বঙ্গবন্ধু তাকে ডেকে বলেছিলেন, ক্ষমা চাইতে। কেবল জিয়াউদ্দীনের মত মুক্তিযোদ্ধা এটা লিখেছে বলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন না উনি। জিয়াউদ্দীন ক্ষমা চাইলেন না, তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে আসার আগেই সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে এসেছেন। মেজর জলিলের পর তিনি দ্বিতীয় পদত্যাগকারী মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। সিরাজ শিকদারের হাত ধরে রাজনীতির পিচ্ছিল পথে পা বাড়ান তিনি,যোগ দেন সর্বহারা পার্টিতে। সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর পর পার্টির সামরিক দিকটি মূলত দেখতেন জিয়াউদ্দীনই। দুর্ধর্ষ এই লোকের পেছনে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে মেজর জলিলের অনুগত যোদ্ধারা,যারা মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারত বিপ্লবের।
শাফায়াতের জিয়াউদ্দীনকে প্রয়োজন। সর্বহারা পার্টির এই নেতার কাছে সাহায্য চেয়ে গিয়েছিলেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের মেজর ইকবাল।
“ক্যু ফেল করলে এক্সটার্নাল ইন্টারভেনশন হতে পারে, তখন আমরা খড়কুটোর মত ভেসে যাব,” একবাক্যে মেজর ইকবালকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন।
জিয়াউদ্দীন মনেপ্রাণে জানতেন, এই বিপ্লব ব্যর্থ। শাফায়াত জামিল দুদিন পর আবারো মেজর ইকবালকে পাঠালেন জিয়াউদ্দীনের কাছে।
“আমাদের সাথে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ থাকবেন এবার।“
জিয়াউদ্দীন ব্যাখ্যা দিলেন এবার,” দেখো, এটাকে সবাই প্রো-ইন্ডিয়ান ক্যু হিসেবেই ধরবে। ক্যু ফেইল করবে আর তোমরা মারা পড়বে।“
মেজর ইকবাল গোঁ ধরলেন,”আপনি মেজর হাফিজউদ্দীনকে বোঝান, বাকিটা আমরা সামলে নেব।“
“আচ্ছা আমি আমার দুই ছেলে, ফজলুল আর মহসীনকে পাঠাব শাফায়াতের কাছে আমার মেসেজ দিয়ে,”জিয়াউদ্দীন জানালেন,” তেজগাঁও এয়ারপোর্টের উল্টোপাশে যে হাবিব ফ্রুটসের দোকানটা আছে, ওখানে দেখা করবে ওরা।“
মেজর হাফিজউদ্দীন ঢাকার ব্রিগেড মেজর, বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার সহায়তা শাফায়াতের দরকার। জিয়াউদ্দীন কথা শুনলেন না। তিনি মেজর হাফিজউদ্দীনের কাছে চিঠি দিলেন,” ডোন্ট গো ফর দ্য ক্যু।“
যথাসময়ে রদেভ্যুঁ থেকে মহসীনকে শাফায়াতের কাছে নিয়ে গেলেন ইকবাল। মহসীন তাকে জিয়াউদ্দীনের চিঠি দিল।
“ডোন্ট প্রোসিড।“
শাফায়াত আর আশা করেছিলেন, এটা নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী ফর্মেশন হল ৪৬ ঢাকা ব্রিগেড। দুই হাজার সৈন্যের এই ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক শাফায়াত জামিল, প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা এই ব্রিগেডের। এদের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। কেন থেমে যাবেন তিনি? অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন তিনি,”জিয়াউদ্দীনের মাথা খারাপ হয়ে গেছে!”
তবে ঢাকা ব্রিগেডের নেতৃত্ব জিয়াউদ্দীনের হাতেই ছিল তার আগে। জেড ফোর্সে একই সাথে যুদ্ধ করেছেন দুজন। দুর্ধর্ষ এই যোদ্ধার কাছে আরেকবার টোপ দিতে চাইলেন শাফায়াত।
ইকবাল এবার দেখা করলেন সর্বহারা পার্টির কর্মী আকা ফজলুল হকের সাথে। বললেন জেলে যত সর্বহারা কর্মী আছে তাদের লিস্ট দিতে, বিপ্লবের পর তাদের মুক্তি দেয়া হবে।
ফজলুল হক জিয়াউদ্দীনের পক্ষে ব্যাখ্যা করলেন, বিপ্লবের কোনো আশা নেই কেন।
“মোশতাকের বিরুদ্ধে এই ক্যু, কাজেই মোশতাকের বিরোধী আওয়ামী লীগের সকল নেতা ছাড়া পাবেন জেল থেকে।ক্ষমতা তাদের হাতেই যাবে। কাজেই সবাই এটাকে দেখবে ভারতপন্থী একটা ক্যু হিসেবে।“
“অসম্ভব,”জোর দিয়ে বললেন ইকবাল,”আমরা ওদের খতম করে দেব!”
মোশতাকবিরোধী যেকোনো ক্যু-ই ভারতীয় দালালদের কীর্তি-এমন কথা চাউর ছিল সবখানে। প্রবল ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরি হয়েছিল দেশে। আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল, এমন কথা শোনা যাচ্ছিল। শাফায়াত ভালোভাবেই জানতেন এটা। জেনারেল ওসমানীর সাথে তার সম্পর্ক স্বভাবতই ছিল খারাপ,কারণ শাফায়াত ছিলেন জিয়ার বন্ধু। অক্টোবর মাসে সেনাসদরের এক মিটিং শেষে ওসমানী বিভিন্ন রেজিমেন্টের জেসিওদের ডেকে বলেন,” মোশতাক সরকারের বিরোধিতা যারা করবে,ভারতের প্ররোচনাতেই তা করবে।তারা সব ভারতীয় এজেন্ট।“
শাফায়াতের শক্তি খর্ব করতে তিনি সাভারে নতুন ব্রিগেড তৈরির প্ল্যানও করছিলেন। কাজেই শাফায়াত আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে- এই বলে ২ নভেম্বর দিবাগত রাত দুটোয় শুরু হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর খুনিদের উৎখাতের অভ্যুত্থান। খালেদ মোশাররফ এর নাম দিয়েছিলেন-“অপারেশন প্যান্থার”।
৩
কালোচিতার প্রহর
রাত তিনটায় বঙ্গভবনের প্রহরায় থাকা মেজর ইকবালের দুটো কোম্পানি চলে এলো ক্যান্টনমেন্টে। ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহের নেতৃত্বে একদল প্লাটুন সৈন্য পাঠানো হলো জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের থেকে আলাদা রাখার জন্য, যাতে জিয়া নিরাপদ থাকেন। তবে ফারুক গং অবশ্য দাবি করেছিল, জিয়া নিজেই শাফায়াতের সাথে এই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, যাতে তিনি যেকোনো অবাঞ্ছিত আক্রমণের শিকার না হন। বন্দি হবার আগে জিয়া তাহেরকে কল দিয়ে বলতে পেরেছিলেন,” সেভ মি, তা…”
কথা শেষ করার আগে ফোন কেড়ে নেয়া হয়েছিল তার কাছ থেকে। যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন তাহের।
শাফায়াত জামিলের নির্দেশে রেডিও-টিভির সকল অফিসার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। শাফায়াতের ওসি মেজর মুসা সেন্ট্রাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কব্জা করে নেয়। রক্ষীবাহিনী থেকে আসা ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে. কর্নেল হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফার বেঙ্গল ল্যান্সার্সের ট্যাঙ্কগুলো প্রতিহত করতে স্টাফ রোড রেলওয়ে ক্রসিঙ্গের সামনে রোডব্লক বসান। এয়ারপোর্টের প্রতিরক্ষায় গেলেন মেজর ইকবাল।
শাফায়াত জামিল রাত দুটোয় চতুর্থ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসারের দপ্তরে অবস্থান নেন। কিন্তু খালেদ মোশাররফ আর নুরুজ্জামান করলেন দেরি।খালেদ এলেন ভোর চারটার দিকে। নুরুজ্জামান সকালে। বঙ্গভবনের ওপর দুটো মিগ ফাইটার চক্কর দিতে লাগল, একটা হেলিকপ্টারও উড়তে লাগল। চতুর্থ বেঙ্গলের কমান্ডার কর্নেল আমিনুল হককে সরিয়ে লে. কর্নেল গাফফারকে বসান খালেদ মোশাররফ। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে সরে যান কর্নেল আমিনুল। খালেদ মোশাররফ নিজের অজান্তেই হারালেন এক শক্তিশালী অফিসারকে।
ওদিকে খুনিচক্র বসে নেই। মেজর ইকবালের দূতিয়ালির খবর জেনে গেছিল মেজর ডালিম। সে তখনই ইকবালকে জিজ্ঞেস করেছিল,”দোস্ত, তোমরা নাকি আমাদের বিরুদ্ধে ক্যু করবা?”
তখন মেজর ইকবাল ভাবছিলেন, ডালিম এই খবর জানল কীভাবে?
ইকবালের কোম্পানি বঙ্গভবন ছেড়ে যেতেই খুনিচক্র বুঝে যায়-বিপদ আসন্ন। বঙ্গভবনকে ঘিরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে বেঙ্গল ল্যান্সার্সের ট্যাঙ্কগুলো। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিল আটটা ট্যাঙ্ক, বাকিগুলো বঙ্গভবনে। উদ্যানে ২ ফিল্ড আর্টিলারির ভারি কামানগুলোও ছিল। লে. কর্নেল ফারুক তার কালো ইউনিফর্ম পড়ে কাঁধে স্টেনগান ঝুলিয়ে সোহরাওয়ার্দীতে এসে উপস্থিত হয়-বিনাযুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী। বঙ্গভবনে রয়ে যান ওসমানী, সাথে বেঈমান মোশতাক। প্রাণশক্তিতে ভরপুর ফারুকের নেতৃত্বে উজ্জীবিত ট্যাঙ্কাররা।
শাফায়াতের হিসেবে ভুল হয়ে গেছে। প্রবল পরাক্রান্ত ৪৬ ব্রিগেডের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তোলে খুনিদের অনুগত নয়শো সৈন্য। ১৫ আগস্ট ল্যান্সার্সদের ট্যাঙ্কে ছিল না কোনো শেল, কিন্তু ১৬ আগস্টেই ক্যান্টনমেন্টে এসে খালেদ মোশাররফ জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স থেকে সবগুলো ট্যাঙ্কের জন্য শেল আনার নির্দেশ দেন। ফলে ট্যাঙ্কগুলো গোলাবারুদ পায়। এখন খুনিচক্র প্রস্তুত। রাজকীয় ত্রিশটি টি-৫৫ ট্যাঙ্ক আর আটাশটি ১৫০ মিলিমিটার কামান নিয়ে মুখোমুখি তারা। আসন্ন গৃহযুদ্ধের ভয়ে থমথম করে সারা শহর। বাতাসে ভাসছে মৃত্যুর ঘ্রাণ।
তিন তারিখ সকালে চতুর্থ বেঙ্গলের কমান্ডে বসে খালেদ তিনটি দাবি সম্বলিত একটি দাবি-নামা তৈরি করলেন-
১। ট্যাঙ্ক ও কামান বঙ্গভবন ও শহর থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠাতে হবে।
২। জিয়া এখন থেকে আর চিফ-অব স্টাফ নন।
৩। বঙ্গভবনে বসে ফারুক-রশিদের কার্যক্রমের অবসান ঘটবে।তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরে চেইন অব কমান্ড মানতে হবে। মোশতাক প্রেসিডেন্ট থাকবেন।
এমন সময় ব্রিগেডিয়ার রউফ আরেকটা দাবি যোগ করে দেন- ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে চিফ অব স্টাফ ঘোষণা করতে হবে । এ প্রস্তাব শুনে খালেদ মৃদু হেসে সম্মতি দিলেন।
বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের বিচারের কোনো কথা উঠেনি এই দাবি-নামায়। একমাত্র শাফায়াত জামিলই চেয়েছিলেন ওদের বিচার করতে; খালেদের মাথায় এমন কিছু ছিল না। বঙ্গভবনে ফোন করে খালেদ মোশাররফের সাথে দর কষাকষি চলতে লাগল এই চারটে দাবি নিয়ে। খুনিচক্রের হয়ে একবার রশিদ, আরেকবার মোশতাক অথবা ওসমানী খালেদের সাথে কথা বলতে লাগলেন। এই টেলিফোন ব্যাটলই পিছিয়ে দিল খালেদকে।
পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শাফায়াত ভালো করে টের পেলেন, খালেদের হিসেবে গরমিল। খালেদ বঙ্গভবনে খুনিদের সাথে টেলিফোন-যুদ্ধ আর কূটনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রশিদ,ঠাণ্ডা মাথায় পনেরো আগস্ট পরবর্তী ঘটনাবলি সামাল দেয়া ফারুকের দক্ষিণবাহু, ইতোমধ্যেই জাতীয় চার নেতাকে হত্যার কাজ সেরে ফেলেছে।কাজেই এখন আর যুদ্ধগ যুদ্ধ খেলার সময় নেই। মোশতাক নিজের চামড়া বাঁচাতে সন্ধ্যায় ওসমানীকে আদেশ দিল, খালেদের কাছে খুনিচক্রের দেশত্যাগের সেইফ প্যাসেজ চাইতে। ওসমানী খুনিচক্রের সাথে কাজ করছিলেন,কাজেই পাপা টাইগার গৃহযুদ্ধ এড়াতে এই কাজে রাজি হলেন। শাফায়াত অন্ধ আক্রোশে দাঁত কামড়াতে লাগলেন এ দাবি শুনে। তিনি একদম প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে আসছেন।খালেদ এই কাজ করবেন-এই ভরসা ছিল তার। কিন্তু আসন্ন গৃহযুদ্ধ আর রক্তপাতের ভয়ে কিনা পিছিয়ে পড়ছেন তিনি! এ কী করে সম্ভব! খালেদ খুনিচক্রকে দেশত্যাগের সেইফ প্যাসেজ করে দিলেন।
ওদিকে সেনাপ্রধানকে বন্দী করায় অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায় অফিসার আর সৈনিকরা। মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী সরাসরি খালেদকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, “সেনাপ্রধানকে বন্দী করে আপনি চেইন অফ কমান্ড ঠিক করবেন?”
এভাবে খালেদ মোশাররফ যেদুটো দাবি নিয়ে অভ্যুত্থান করেছিলেন, তা সবার সামনে মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে যায়।
কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট আর বঙ্গভবন তখন দুই দেশ-অত্যন্ত উত্তেজনা দুপক্ষের মাঝে। যেকোনো মুহূর্তে লেগে যাবে গৃহযুদ্ধ। এমন সময় আরেকটা ঘটনা ক্রমেই ক্ষয়ে আসতে থাকা খালেদের অবস্থাকে নড়িয়ে দেয়।
৪ নভেম্বর, ধানমণ্ডি।
ধানমণ্ডিতে খালেদের ভাই রাশেদ মোশাররফ আর তার মা একটি মিছিল বের করেন ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের নিয়ে। স্বাগত জানান এই বিপ্লবকে। মিছিল থেকে শ্লোগান দেয়া হয় বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর। লেখা হয়ে যায় খালেদের নামে ডেথ ওয়ারেন্ট। সবাই ধরে নেয়, আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় আবারো ভারতের দালালরা এসেছে ক্ষমতায়। এই আগুনে ঘি ঢালে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার হাজার হাজার লিফলেট, যাতে খালেদকে ভারতের দালাল বলে অভিহিত করা হয়।
এটা খালেদ নিজেও জানতেন, এখন তাকে ভারতের চর বলে দাবি করা হবে সবখানে। দুঃখে তিনি তার মাকে বলেছিলেন,” মা, তোমরা আমাকে মেরে ফেললে।“
ওদিকে ভারতের আকাশবাণী উচ্ছ্বসিত প্রশংসা জানায় এই ক্যু-কে। ভারতে তখন চলে তীব্র সরকারি মিডিয়া সেন্সরশিপ। সব খবর সরকারের মাধ্যমে অনুমোদন পেয়ে আসত। কাজেই সবাই সন্দিহান হয়ে উঠল, আসলেই কি এর পিছে আছে ভারত?
রাত এগারোটায় ঢাকা থেকে ব্যাঙ্ককের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে খুনিচক্রকে বহনকারী বিশেষ বিমান। যাবার আগে মেজর শরিফুল হক ডালিম তাহেরের সাথে পরিকল্পনা করে যান আরেকটা আঘাত হানার। এরা চলে যাবার পর সবাই জানতে পারলেন, খুনিচক্র জাতীয় চার নেতাকেও খুন করেছে সেন্ট্রাল জেলে। স্তম্ভিত হয়ে গেল সবাই, খালেদ-শাফায়াত হতভম্ব হয়ে গেলেন। অফিসাররা উত্তেজিত- খালেদ সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড আর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের জন্য এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন-দুটোর একটাও তো হল না! সবাই বলাবলি করতে লাগলেন, এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে অভ্যুত্থান করলাম কেন আমরা?
ক্রমশ সরে আসতে থাকে দেশপ্রেমিক খালেদ মোশাররফের পায়ের নিচের মাটি।
৪
বাতাসে বিপ্লবের ঘ্রাণ
শাফায়াতকে আবারো মাঠে নামতে হচ্ছে পরিস্থিতি বাঁচানোর জন্য। খালেদকে উদ্ধার করতেই হবে এই গাড্ডা থেকে। আর তার প্রথম কাজ হবে মোশতাককে সরানো। কাকে বানানো যায় প্রেসিডেন্ট?
জিয়ার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া হলো। মেজর জাফর ইমাম ছিলেন সেখানে।জিয়ার মত উচ্চাভিলাষী মানুষ নিশ্চয়ই রাজি হবে আর্মি চিফের পদ ছেড়ে প্রেসিডেন্ট হতে!
“স্যার, বঙ্গভবনে মোশতাকের সাথে পরবর্তী রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে অর্থাৎ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা চলছে। আপনি যদি আগ্রহী থাকেন তাহলে আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন।খালেদ সেনাবাহিনীর প্রধান থাকবে। এ ব্যাপারে খালেদ মোশাররফের কোনো আপত্তি নেই।“
জিয়া ঠান্ডা মাথায় তাদের উত্তর দিয়েছিলেন, “আমার প্রেসিডেন্ট হবার শখ নেই, আমাকে কাগজ কলম দাও আমি অবসর গ্রহণের জন্য দরখাস্ত করব। আমাকে পেনশন পাঠালেই আমি খুশি থাকব।“
অবশেষে চিফ জাস্টিস আবু সায়েম চৌধুরীকে প্রেসিডেন্ট বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন শাফায়াত জামিল, খালেদ তখনো ব্যস্ত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে তিনি আরো দুই বাহিনীর প্রধানের সাথে শেয়ার করবেন কি না সে নিয়ে দর কষাকষিতে।
৫ নভেম্বর, বঙ্গভবন।
শাফায়াত জামিল বঙ্গভবনে গেলেন। খালেদ মোশাররফ মোশতাকের মারপ্যাচে আটকে গেছেন, ওসমানী কিছুতেই নিয়ম ভেঙে তাকে সেনাপ্রধান করতে দেবেন না। শাফায়াত এসময় শক্তিমান সাহসী অফিসার কীভাবে দাবি আদায় করে, দেখিয়ে দিলেন সবাইকে।
মিটিং এর একপর্যায়ে মোশতাক করিডোরে খালেদের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়।
“আই হ্যাভ সিন মেনি ব্রিগেডিয়ার্স অ্যান্ড জেনারেলস অব পাকিস্তান আর্মি।ডোন্ট ট্রাই টু টিচ মি!”
মোশতাকের পাশে দাঁড়ানো ওসমানী। শাফায়াত জামিল এসে দাঁড়ায় সেখানে। মেজর ইকবাল শ’খানেক সৈন্য নিয়ে সেখানে ছিলেন।মোশতাকের কথায় উত্তেজিত হয়ে জবাব দিলেন তিনি,
“ইউ হ্যাভ সিন জেনারেলস অব পাকিস্তান আর্মি। নাউ ইউ সী দ্য মেজরস অব বাংলাদেশ আর্মি।“
সৈন্যরা গুলি চালাবার প্রস্তুতি নেয়। ওসমানী আহবান জানান শাফায়াতকে,” শাফায়াত সেভ দ্য সিচুয়েশন।“
শাফায়াত দুজনের মাঝে এসে মোশতাককে কেবিনেট মিটিং এ পাঠিয়ে দেন। ভেতরে ঢুকে শাফায়াত প্রথমে জেল হত্যার কথা খালেদকে না জানানোর দায়ে গ্রেফতার করেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে। এরপর মোশতাককে বলেন,
“স্যার, আপনি আর এপদে থাকতে পারবেন না।কারণ আপনি একজন খুনি।জাতির পিতাকে হত্যা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন।জেল হত্যা আপনার নির্দেশে হয়েছে। আপনি অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। আপনার পদত্যাগের পর প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্ট হবেন।“
খালেদকে সেনাপ্রধান করার জন্যও মোশতাককে চাপ দিলেন শাফায়াত। প্রথমে গাইগুই করছিল মোশতাক, কিন্তু শাফায়াত স্টেনগান হাতে ঠেসে ধরে এই বিশ্বাসঘাতককে। আর্মি ইণ্টেলিজেন্সের প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফ গিয়ে জিয়ার পদত্যাগপত্র সই করিয়ে আনলেন। খালেদকে সেনাপ্রধানের ব্যাজ পরিয়ে দেয়া হলো।
খালেদ মোশররফ যে কাজটি কথায় আদায় করতে পারেননি, শাফায়াত জামিল তা বাহুবলে আদায় করে নিলেন। পরেরদিন আবু সায়েম চৌধুরী ভাষণ দিলেন, ঠিক করা হলো ৭ নভেম্বর সকালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ভাষণ দেবেন খালেদ মোশাররফ।
কিন্তু মেঘে মেঘে অনেক বেলা চলে গেছে। শাফায়াত জামিল-খালেদ মোশাররফের বিপ্লবের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে জিয়ার পদত্যাগ। ক্যান্টনমেন্টে বুনো আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল এই খবর-‘জিয়া বন্দী, সেনাপ্রধান বন্দী।‘ কালুরঘাটের বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়ার সাতাশে মার্চে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সামরিক বাহিনীসহ সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। জিয়ার জনপ্রিয়তা আগে থেকেই ছিল আকাশছোঁয়া। এখন বন্দি অবস্থায় পদত্যাগপত্রে সই করিয়ে নেয়ার তা আগ্নেয়গিরির মত লাভা উদ্গিরণের প্রস্তুতি নিতে লাগল। আর এই আগুনে ঘি ঢেলে চলেছে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা।
ক্যান্টনমেন্টের আকাশে বাতাসে তাহের ছড়িয়ে দিয়েছেন বিষ- খালেদ মোশাররফ ভারতের চর, দালাল। শত শত লিফলেট উড়ছে বাতাসে-ভারতের আগ্রাসনের দোসর খালেদ মোশাররফ আর তার সঙ্গীরা। সাধারণ সৈনিকের ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে খালেদ মোশাররফসহ অভ্যুত্থানের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে দিয়েছেন তাহের।
ওস্তাদের মার শেষরাতে, ঠিক তেমনি তাহেরও শেষ চাল চালতে যাচ্ছেন। এতদিনের স্বপ্ন পূরণ করবেন তিনি, জিয়াকে সামনে রেখে বিপ্লব হবে এদেশে, জিয়া হবে হাতের পুতুল।
সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই– শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠার অপেক্ষার রাত নেমে এলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের আকাশে।
৫
ইট ইজ টুনাইট, অর নেভার
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল গুল হাসান খানের প্রথম ট্যাঙ্ক ডিভিশনের একজন অফিসার ছিলেন মেজর জলিল। তার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার খবর পেয়ে জেনারেল খান তিনি স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন,”পাকিস্তান সেনাবাহিনী একজন দক্ষ অফিসার হারাল।“
কোনো পাকিস্তানি জেনারেলের স্মৃতিকথায় এভাবে আর কোনো বাঙালি অফিসারের নাম আসে নি।
মেজর জলিল প্রথম থেকেই ভারতের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার বিরোধী ছিলেন। পরবর্তীতে ভারতীয় অফিসারদের সাথে সর্বদা পাল্লা দিয়ে গেছেন মেজর জলিল। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সেক্টরগুলো থেকে যখন অস্ত্র ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জমা নেয়া শুরু করে, তখন মেজর জলিল অস্ত্র জিয়াউদ্দীনের মাধ্যমে দেশে পাঠিয়ে দেন। এরপর ভারতীয় সৈন্যদের লুটপাটের প্রতিবাদ করেন। বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাহায্যে জনসভার আয়োজন করে তিনি ভারতীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে অস্ত্রধারণের আহবান জানান। এর ফলাফলও তাকে পেতে হয়েছিল।
৩১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় ভারতীয় সেনাবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী একজন সেক্টর কমান্ডার-যার সেক্টরে ট্রেনিং নিয়েছে ত্রিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা। জলিলই একমাত্র সেক্টর কমান্ডার যিনি কোনো খেতাব পাননি।
মেজর জলিল মৃত্যুর আগপর্যন্ত দুঃস্বপ্নে এই দৃশ্যটি দেখতেন, তার কানে শ্মশানের বাতাসের শব্দে ভেসে আসত- রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা আনলে তোমরা?
১৯৭২ সালের ২৮ জুলাই সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন মেজর জলিল। পদত্যাগের পর শেখ কামাল তাকে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে। জাতির পিতা মৃদু ভর্তসনার সুরে তাকে বলেন,”তুই চলে গেলে আমার ট্যাঙ্ক চালাবে কে?”
“আপনার তো ট্যাঙ্কই নেই!” মেজর জলিলের তীব্র শ্লেষ। এর কদিন পর মিশরের আনোয়ার সাদাত বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ত্রিশটি টি-৫৫ ট্যাঙ্ক উপহার দিয়েছিলেন।
সেনাবাহিনী ছেড়ে জাসদের সভাপতি হলেও মেজর জলিলের সাথে ছিল তার ছেড়ে আসা সেক্টর-নয়ের মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের সুসম্পর্ক। মেজর জলিলের অধীনস্ত অফিসার জিয়াউদ্দীন ততদিনে সর্বহারা দলে যোগ দিয়েছেন। গুরু-শিষ্যে মিলে বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পুরনো মিশন শুরু করলেন। জলিলের অনুগত সৈন্যদের নিয়ে ১৯৭৩ সালের প্রথম দিন বাংলাদেশ রেভ্যুলুশনারি কমান্ডো ফোর্স ও সুইসাইড স্কোয়াড গঠিত হয়। বিমানবাহিনীর জুনিয়র কমিশণ্ড অফিসার ও নন কমিশন্ড অফিসারদের একটি দল ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে জলিলের সাথে ঢাকার নাখালপাড়ায় মিটিং করে। শুরু হয় এদের সবার রাজনৈতিক দীক্ষা।
অপরদিকে ছিলেন কর্নেল তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। এ দলটি গড়ে উঠেছিল তাহেরের অনুগত সৈন্যদের দ্বারা। কর্নেল তাহের ১৯৭২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশে ফিরে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল নিযুক্ত হন। মেজর জলিলের বিচারের ট্রাইবুন্যালের বিচারক ছিলেন তিনি। জলিলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে আসা সরকারি কর্মকর্তা স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন জানার পর তাহের জলিলের মামলা বাতিল করে দিয়ে বলেন,” মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডারের বিরুদ্ধে কোনো স্বাধীনতাবিরোধীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।“ ট্রাইব্যুনাল জলিলকে বেকসুর খালাস দেয়।
তাহের দেশে ফিরে ৪৪ কুমিল্লা ব্রিগেডের দায়িত্ব নেন, আর তার বন্ধু জিয়াউদ্দীন নেন ৪৬ ঢাকা ব্রিগেডের। দুজনই শ্রেণিহীন সেনাবাহিনীর আদর্শে উজ্জীবিত ছিলেন। তাহের নিয়মিত বামপন্থী রচনা পড়তেন, এঙ্গেলসের লেখা মার্ক্সের ‘ফ্রান্সের শ্রেণিসংগ্রাম’ বইয়ের ভূমিকা পড়ে বিশেষভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। ভারতের আধিপত্য বিস্তারের অপপ্রয়াস দেখে তাহেরও মনে মনে জিয়াউদ্দীন আর জলিলের মত বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। একই সাথে তিনি হয়ে ওঠেন তীব্রভাবে বঙ্গবন্ধুবিরোধী। একাত্তরের গোপন সেনা পরিষদের সদস্য মেজর ডালিমের সাথে কথা হয় তার। দুজনে ভিন্নপন্থায় একই লক্ষ্যে কাজ করতে থাকেন- বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত।
১৯৭৪ সালে সেনাবাহিনীকে যখন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব দেয়া হয় তখন নারায়ণগঞ্জের দায়িত্ব পায় লে.কর্নেল ফারুক। তখন তাহের ছিলে নারায়ণগঞ্জ ড্রেজারের ডিরেক্টর। তাহেরের কাছে ফারুক যাতায়াত করব। একদিন ফারুক একটা ফোক্সওয়াগন গাড়িতে করে তাহেরের বাসায় আসেন। গাড়ির ড্যাশবোর্ডে একটা চাইনিজ পিস্তল দেখিয়ে সোজাসুজি সে তাহেরকে বলে, “স্যার, এই পিস্তল দিয়ে আমি শেখ মুজিবকে মারব। আপনি আর কর্নেল জিয়াউদ্দীন দেশ চালাবেন।“
বঙ্গবন্ধু দেশের সাথে প্রতারণা করেছেন, এই বিশ্বাস পোষণ করতে থাকেন তাহের। পনেরো আগস্টের ঘটনার প্রতিক্রিয়া ছিল তার এরকম,” ওরা একটা বড় রকমের ভুল করেছে। শেখ মুজিবের লাশটা কবর দিতে অ্যালাউ করা উচিত হয় নাই। ওখানে এখন মাজার বসবে। ওদের উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া।“
“আমার বিশ্বাস যে জনগ্ণ একদিন শেখ মুজিবকে নেতা বানিয়েছে তারাই একদিন স্বৈরাচারী মুজিবকে ধ্বংস করবে। জনগণ কাউকে ষড়যন্ত্র করার অধিকার দেয়নি।“- সামরিক আদালতের জবানবন্দীতে বলেছিলেন তাহের।
তাহের বিপ্লবী গণবাহিনী তৈরি করার সাথে সাথে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে নিজের স্বপ্নকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ শুরু করেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে সেসময় একটা দলাদলি চলছিল মুক্তিযোদ্ধা বনাম পাকিস্তান প্রত্যাগতদের মধ্যে। মুক্তিযোদ্ধারা দুই বছরের সিনিয়রিটি পাওয়ায় অনেকেই তাদের অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের সিনিয়র হয়ে যান। এটা অমুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে একটা হীনমন্যতার জন্ম দেয়। বিভিন্ন ইউনিটে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররাই সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন অমুক্তিযোদ্ধাদের পাত্তা না দিয়ে। যেমন- বেঙ্গল ল্যান্সার্সের উপপ্রধান বা টুআইসি ছিল লে. কর্নেল ফারুক; কমান্ডার ছিলেন একজন পাকিস্তান ফেরত কর্নেল। ফারুক পাত্তাও দিত না তার কমান্ডারকে, পুরো ইউনিট চলত তার কথায়। তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এই বিভাজনের সুযোগ নেয়।
৬ নভেম্বর, কলাবাগান।
জাসদের কার্যকরী ফোরামের মিটিং এ হাজির হন কর্নেল তাহের। মিটিং এ ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আখলাকুর রহমান, হাসানুল হক ইনু, খয়ের এজাজ মাসুদ প্রমুখ নেতা। একটু পরেই অসামরিক পোশাক পরা এক তরুণ সেনাকর্মকর্তা একটা চিরকুট দেন তাহেরের কাছে। এটা জিয়ার হাতে লেখা বলে জানান তাহের।
“আই অ্যাম ইনটার্ন্ড। মাই মেন আর আউট দেয়ার। আই ক্যান নট টেক দ্য লিড। ইফ ইউ টেক দ্য লিড, মাই মেন উইল ফলো ইউ।“
তাহের আরো জানান, জিয়া তাকে ফোন করে সাহায্য চেয়েছেন। তিনি এ বিপ্লবে জাসদের সহায়তা চাইলেন।
বেঁকে বসলেন জাসদের নেতারা। পাকিস্তানের বাইশ পরিবারের একট, সায়গল পরিবারের চিফ ইকোনমিক অ্যাডভাইজার ছিলেন আখলাকুর রহমান, দুঁদে অর্থনীতিবিদ। জাসদের অন্যতম এই নেতা বলে উঠলেন,” ইটা কিতা কথা? আমরা তাইনরে চিনি না!”
সকলেরই সেই মত, কেউ জিয়াকে চেনেন না। কারো সাথে কথাও হয়নি জিয়ার। তাহের দর্পভরে বললেন,” আমাকে বিশ্বাস করলে জিয়াকেও বিশ্বাস করতে হবে। হি উইল বি আন্ডার মাই ফুট!”
জাসদের নেতারা বিভ্রান্ত। তাহের আরেকটা চিরকুট বের করলেন, এটা এসেছে সেনা সংস্থার গোয়েন্দা শাখা থেকে।
“মোশতাকস মেন আর মুভিং ফাস্ট, দ্য আয়রন ইজ টু হট। ইট ইজ টাইম টু স্ট্রাইক।“
তাহের ইতোমধ্যেই গণবাহিনীকে মুভ করার নির্দেশ দিয়েছেন। বেতার কেন্দ্র দখলে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণবাহিনীর সদস্যরা। অস্ত্র হাতে স্যান্ডেল পায়ে সবাই চলে এসেছে বিপ্লবে। সবাই জানে বিপ্লব হচ্ছে, কিন্তু কীভাবে হচ্ছে, কেন হচ্ছে কেউ জানে না। সেনাবাহিনীর সাধারণ সদস্যদের মাঝে লিফলেট ছড়ানো হচ্ছে- খালেদ ভারতের দালাল। অফিসারদের রেষারেষিতে সৈনিকের প্রাণ যাবে কেন? অফিসারদের বাড়াবাড়ি থামাতে এক হতে হবে।
তাহের বলশেভিক বিপ্লবের সাথে মিলিয়ে বিপ্লবের দিন ধার্য করেছিলেন ৭ নভেম্বর। লেলিনের মত করে তিনি ঘোষণা করলেন,” ইট ইজ টুনাইট, অর নেভার।“
কথাটা সত্য হয়েছিল। তাহেরের এই অতি আত্মবিশ্বাসী জুয়ার ধ্বংস হয়ে গেছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে সাড়াজাগানো বিপ্লবী দল জাসদ। তিনি নিজেও ডুবেছিলেন, সবাইকে ডু্বিয়েছিলেন।
৬
শ্লোগান, বারুদ আর রক্তের রাত
৭ নভেম্বর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।
বিপ্লব শুরু হবার কথা ছিল রাত বারোটায়। কিন্তু নানা হট্টগোল আর বিভ্রান্তিতে আরো আধঘণ্টা আগেই শুরু হয় এই বিদ্রোহ।
রাত বারোটা। সুবেদার মেজর আনিসুল হকের ইঙ্গিতে টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের লাইন থেকে একটি ট্রেইসার বুলেট আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে রাতের আকাশে উঠল। এটাই ছিল সঙ্গকেত। ক্যান্টনমেন্টের উত্তরপ্রান্তের থার্টি-এইট এলএএ রেজিমেন্ট প্রচণ্ড শব্দে আকাশে এন্টি-এয়ারক্র্যাফট গান ফায়ার করে উত্তর দিল। শুরু হল উপমহাদেশের দ্বিতীয় সিপাহি বিদ্রোহ।
গোটা ক্যান্টনমেন্ট সহসা জীবন্ত হয়ে উঠল। চারদিকে গুলির শব্দ, ভয়াবহ অবস্থা। হট্টগোল, আগুন, চিৎকার। প্রবল ক্রোধে সাধারণ সিপাহিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল বিদ্রোহে। চারদিকে একই আওয়াজ- সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই!
ওদিকে জিয়াকে মুক্ত করতে ছুটে গেছে টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের সৈন্যরা। এর নেতৃত্বে মেজর মহিউদ্দীন। জিয়াকে প্রহরা দেয়া প্রথম বেঙ্গলের সৈন্যরা সরে পড়েছে। পাঞ্জাবি পরা জিয়াকে কাঁধে চড়িয়ে বিপ্লবী সিপাহিরা নিয়ে এলো টু-ফিল্ডের কমান্ডে। সবার লক্ষ্য এখন টু-ফিল্ড আর্টিলারির দিকে। চারদিকে আওয়াজ- জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার কর্নেল হামিদ সিভিলিয়ান পোশাকে এলেন টু-ফিল্ডে। এসে দেখলেন বাইরে পায়চারি করছেন সদ্য সাবেক চতুর্থ বেঙ্গলের কমান্ডার কর্নেল আমিনুল হক। কর্নেল হামিদের সাথে হাত মিলিয়ে জিয়ার কাছে নিয়ে গেলেন তিনি। ভেতরে টু-ফিল্ডের কমান্ডার লে কর্নেল রশিদের চেয়ারে নায়কের সাজে আলো ঝলমলে চোখে বসে আছেন জিয়াউর রহমান। আদর করে পাশে বসালেন কর্নেল হামিদকে।
“হামিদ, কথাটা মনে আছে? এক মাঘে…” ঘাড় কাত করে ফিসফিসিয়ে বললেন জিয়া। হামিদ হাসলেন।
এর আগে মেজর মহিউদ্দীন, সুবেদার মেজর আনিসুল হক বিপ্লবী সৈন্যদের নিয়ে জিয়ার বাসভবনে পৌঁছে গিয়েছিল। ফার্স্ট বেঙ্গলের প্লাটুনকে হটিয়ে দিয়ে তারা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে।
জিয়া তার স্ত্রীকে নিয়ে পেছনের করিডোরে বেরিয়ে আসেন। মহিউদ্দীন বলে,” স্যার, আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। আপনি আসুন।“
“দেখ, আমি রিটায়ার করেছি। আমি কিছুর মধ্যে নাই। আমি কোথাও যাব না। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।“
“স্যার আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। আমরা নিয়েই যাব। আমরা আপনাকে আবার চিফ বানাব। আল্লার দোহাই আপনি আসুন।“মহিউদ্দীনের আহবান।
খালেদা জিয়া এসে দাঁড়ালেন মাঝে,” দেখুন ভাই, আমরা রিটায়ার করেছি। আমাদের নিয়ে টানাটানি করবেন না। দিয়া করে আমাদের ছেড়ে দিন।“
“স্যার আপনাকে যেতেই হবে। আপনি আসুন,” বলে চ্যাংদোলা করে মহিউদ্দীন, আনিস আর অন্যান্য সিপাহিরা তাকে কাঁধে উঠিয়ে জিপে তুলে ফেলল। শ্লোগান উঠল,” জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ! সেপাই সেপাই ভাই ভাই!”
বলে রাখা ভালো, টু-ফিল্ড আর্টিলারি হলো লে. কর্নেল রশিদের ইউনিট। জিয়াকে মুক্ত করতে গিয়েছিল এরাই। পরে কর্নেল আমিনুল হকের চতুর্থ বেঙ্গল জিয়ার চারপাশে নিরাপত্তাব্যুহ তৈরি করে; কারণ ততক্ষণে শুরু হয়েছে আরেক রক্তক্ষয়ী পালাবদল।
টু-ফিল্ড আর্টিলারিতে এসে পৌঁছায় সুবেদার সারোয়ারের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা। জিয়াকে জানায়,” কর্নেল তাহের আমাদের নেতা, আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। “
জিয়া নাটকীয়ভাবে বলেন,” তাহের-আমার বন্ধু কোথায়? সে আমার নেতা। নিয়ে এসো তাকে এখানে।“
জিয়ার আচরণে মুগ্ধ বিপ্লবীরা তাকে না নিয়েই ফিরে আসে। বেঁচে যান জিয়া। কারণ তাহেরের প্ল্যান ছিল জিয়াকে বাইরে নিয়ে এসে তার বড়ভাই সার্জেন্ট আবু ইউসুফের ৩৩৬ এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় আটকে রাখা। মূল প্ল্যানে ছিল সুবেদার মজুমদার জিয়াকে উদ্ধার করবে, কিন্তু আগেই টু-ফিল্ডের সৈন্যরা প্ল্যানে বাগড়া দেয়। খালেদ মোশাররফকে আটক করার দায়িত্ব ছিল নায়েক সিদ্দিকী আর সারোয়ারের ওপর। কিন্তু খালেদ খবর পেয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করলে এই প্ল্যানেও ছাই পড়ে। অগত্যা তাহেরকেই আসতে হয় জিয়ার কাছে।
জিয়া ইতোমধ্যে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী আর কর্নেল আমিনুলকে পাশে এনেছেন। তিনি উপস্থিত সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, তিনি রক্তপাত চান না। কাউকে বিনা বিচারে আঘাত না করার স্পষ্ট আদেশ দেন তিনি।
বঙ্গভবনে ছিলেন শাফায়াত জামিল। প্রথম বেঙ্গলের ব্রিগেড মেজর হাফিজউদ্দীন একজন জেসিওকে নিয়ে রাত দশটায় শাফায়াত জামিলের কাছে যান। তারা জানান, খালেদ মোশাররফকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। শাফায়াত বঙ্গভবনে ছুটে যান খালেদের কাছে, কিন্তু খালেদ ততক্ষণে বেরিয়ে গেছেন। এমন সময় জিয়ার ফোন আসে, জিয়া খালেদ মোশা্ররফের কাছে ফোন করেছেন, তিনি বললেন, “লেট আস ফরগেট অ্যান্ড ফরগিভ অ্যান্ড ইউনাইট দ্য আর্মি।“
জিয়া বুঝতে পারছিলেন, জাসদের সাথে সমঝোতা করাটা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। পরের কথা পরে ভাবা যাবে, আগে খালেদের সাথে এক হয়ে বিচারপতি সায়েমকে সামনে রেখে সেনাবাহিনীকে এক রাখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
কিন্তু ফোন রিসিভ করেছেন শাফায়াত জামিল, তিনি ফিরিয়ে দিলেন জিয়ার প্রস্তাব। বঙ্গভবনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকা বিপ্লবীদের প্রতিরোধ করার জন্য দাঁড়ায় শাফায়াতের ক্যাপ্টেন দীপকের ইউনিট। ৪৬ ঢাকা ব্রিগেড তার সাথে আছে, এই বিশ্বাসে বলীয়ান শাফায়াত জামিল প্রত্যাখ্যান করেন এই সন্ধিপ্রস্তাব,” নাথিং ডুয়িং উই উইল সর্ট দিস আউট ইন দ্য মর্নিং। আপনি যা করার অফিসারদের নিয়ে করতে পারতেন, সিপাহিদের জড়ালেন কেন?”
এসময় তিনি টের পেলেন, তাদের কথোপকথন কেউ অনুবাদ করে দিচ্ছে ইংরেজিতে। তাদের কথা কোনো এক বিদেশি গুপ্তচর পাচার করছে বঙ্গভবনের ভেতরে বসেই। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার এই দশা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন শাফায়াত জামিল।
ইতোমধ্যে ক্যাপ্টেন দীপকের প্রতিরোধ ভেঙে গেছে। সব শেষ-বুঝতে পারলেন শাফায়াত। বঙ্গভবনের দেয়াল টপকে পালাতে গেলেন তিনি, পা ভেঙে গেল তার। পড়ে বহু কষ্টে পালাতে সক্ষম হন তিনি। ভেঙে পড়ল খালেদ মোশাররফের ১২০ ঘণ্টার ক্যু। এখন সময় কেবলই তাহেরের উন্মত্ত বিপ্লবীদের।
৭
একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি
রাত বারোটায় সিপাহি বিপ্লবের সংবাদ পেলেন খালেদ মোশাররফ। সাথে সাথেই তিনি তার প্রাইভেটকারে করে বেরিয়ে পড়লেন বঙ্গভবন থেকে। তার সাথে ছিলেন তখন কর্নেল নাজমুল হুদা ও লে.কর্নেল এটিএম হায়দার। দুজনই এসেছিলেন ৩ নভেম্বরের পর।
কর্নেল হুদা ছিলেন পাকিস্তান আর্মির সাপ্লাই কোরের অফিসার। উনার নাম জড়িত ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাথে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পদাতিক বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন ৭২ রংপুর ব্রিগেডের কমান্ডার। ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করেন। সেই সময় তিনি ছিলেন ৪৪ কুমিল্লা ব্রিগেডের কমান্ডার। এই ব্রিগেডকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কুমিল্লা, নোয়াখালি ও সিলেটে অভিযান চালানোর জন্য। ১৯৭২ সালেও এমন একটি অভিযান চালানো হয়েছিল, কিন্তু এর মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা এত বেশি হস্তক্ষেপ করেছিল যে বঙ্গবন্ধুকে এই অপারেশন বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এজন্য কুমিল্লা ব্রিগেডের প্রভাবশালী কর্মকর্তা মেজর ডালিম আর মেজর হায়দার সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এই অপারেশন নিয়ে। তখন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ বলেছিলেন, “শেখ মুজিব এইবার তার মরা বাপকেও ছাড়বেন না।“
কিন্তু অভিযানে যখন দেখা গেল অবৈধ অস্ত্রের বেশিরভাগই পাওয়া যাচ্ছে আওয়ামী লীগের লোকজনের কাছে, তখন বঙ্গবন্ধুকে তার দলের লোকেরা চাপ দিয়ে এই অপারেশন বন্ধ করায়। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ কর্নেল হুদাকে নির্দেশ দিলেন অপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার জন্য। অসম্ভবরকমের দেশপ্রেমিক কর্নেল হুদা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, তিনি এটা কখনোই করবেন না। পরবর্তীতে শফিউল্লাহ তাকে আর মেজর ডালিমকে নিয়ে গেছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। সেখানেও তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, এই অপারেশনের সকল দায় তার একার আর যদি এই অপরাধে কাউকে শাস্তি দিতে হয়, তাহলে একমাত্র তাকেই শাস্তি দিতে হবে।
খালেদ মোশাররফ শাফায়াত জামিলকে না জানিয়ে ঢাকায় ৪ নভেম্বর সকালেই ডেকে আনেন লে. কর্নেল নওয়াজীশের দশম বেঙ্গল আর লে. কর্নেল জাফর ইমামের পঞ্চদশ বেঙ্গলকে। এই দুটি ইউনিটই ছিল কর্নেল হুদার ৭২ রংপুর ব্রিগেডের। যমুনা নদীর পাড়ে আরিচাঘাটে এসে এদের আগমনের খবর কানে আসে শাফায়াত জামিলের। তিনি অবাক বিস্ময়ে তার অধীনস্ত অফিসার লে. কর্নেল সাখাওয়াত হোসেনকে বলেছিলেন, “এরা এত তাড়াতাড়ি কীভাবে এলো?”
খালেদ এই দুটো ইউনিটকে ঢাকায় এনেছিলেন ৪৬ ঢাকা ব্রিগেডের শক্তিকে ব্যালেন্স করার জন্য। শাফায়াত জামিলের অধীনেই ছিল ঢাকার সব পদাতিক ইউনিট। ওসমানী তার শক্তিকে কাউন্টার করতেই কর্নেল মান্নাফের অধীনে ৭৭ সাভার ব্রিগেড সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যেটা করার আগেই অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বসেন খালেদ। শাফায়াত খালেদের এই চালটা ঠিক মেনে নিতে পারেননি।
এটিএম হায়দার এসেছিলেন চট্টগ্রাম থেকে, বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে। ৫ নভেম্বর ঢাকায় আসেন তিনি। ৬ নভেম্বর মেজর আমিন আহম্মেদ চৌধুরীর সাথে তিনি দেখা করেন, রাতে উনার বাসাতেই ডিনা রকরেন তিনি। মেজর আমিনের স্ত্রী লুতফা আমিনকে তিনি বলে রেখেছিলেন,” আমি স্যারের মত সাহেব না, আমি মুরগি খাই না। আমার জন্য ছোট্মাছ রান্না করবেন।“
সেখান থেকেই তিনি গেছিলেন বঙ্গভবনে খালেদের সাথে দেখা করতে। তার সুদূর পার্বত্য চট্টগ্রামের রুমা থেকে ঢাকায় আসার আরেকটা কারণও ছিল- খালেদ তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন কে ফোর্সের সাবেক যোদ্ধাদের সমর্থন আদায় করা। শাফায়াতের শক্তিতে বলীয়ান খালেদ এক কর্নেল হুদা ছাড়া আর কাউকেই এন যেন বিশ্বাস করতেন না।
খালেদ মোশাররফ প্রথমে ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান। সেখানেই নুরুজ্জামান তাকে পরামর্শ দেন কাপড় পালটে নেবার। খালেদ নুরুজ্জামানের একটা ছোট সাইজের শার্ট পরে নিলেন। এরপর কলাবাগানে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তিনজন সাভার রওনা হয়েছিলেন। হঠাৎ মোহাম্মদপুরের আসাদগেটের কাছে গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। তখন শেরে বাংলা নগরে তৈরি হচ্ছিল জাতীয় সংসদ ভবন। সেখানেই মোতায়েন ছিল দশম বেঙ্গল। রংপুর থেকে ৪ নভেম্বর ঢাকায় এই রেজিমেন্টকে এনেছিলেন খালেদ মোশাররফ। মুক্তিযুদ্ধের সময়ই সেক্টর-দুইয়ের অধীনে ফেনীর বিলোনিয়ার এই রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানেই আশ্রয় নেবার সিদ্ধান্ত নেন তারা।
কর্নেল নওয়াজিশ সাথে সাথেই জিয়াকে ফোন করেন জানান, খালেদ মোশাররফ এখানে এসেছেন। জিয়া তাকে বারবার করে বলে দেন, খালেদকে যেন নিরাপত্তা দেয়া হয়। এ কথা কর্নেল নওয়াজীশ পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনকে বলেছিলেন। খালেদ মোশাররফকে রক্ষা করতে না পারার কাফফারা নওয়াজীশকে দিতে হয়েছিল। ১৯৮১ সালে লে. জেনারেল মঞ্জুরের বিদ্রোহে অংশ নেন তিনি। জিয়া হত্যামামলায় ফাঁসিতে ঝুলে প্রাণ দেন তিনি।
জিয়ার স্পষ্ট আদেশ ছিল বিনাবিচারে কাউকে শাস্তি দেয়া হবে না। জিয়ার এই কথা শুনেছিলেন কর্নেল আমিনুল হক। এছাড়াও তার পাশে থাকা মেজর আমিন আহম্মেদ, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, লে. কর্নেল হামিদও শুনেছেন এই কথা এবং নিজ নিজ স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন। অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা কর্নেল শাফায়াত জামিলও বলেছেন, টু-ফিল্ডে আসার পর জিয়ার প্রথম নির্দেশ ছিল,” There will be no bloodshed. No retribution. Nobody will be punished without proper trial.” শাফায়াতের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা লে.কর্নেল হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফারও বলেছেন, জিয়ার নির্দেশ ছিল খালেদ মোশাররফ ও তার সাথীদের ক্ষতি না করা। মেজর জাফর ইমাম এবং মেজর নাসির উদ্দীনও জিয়ার এই নির্দেশের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন-দুজনের স্মৃতিকথায় লেখা আছে এটা।
এরপরেও জিয়ার আদেশ অমান্য করে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের তিন বীর যোদ্ধাকে কাপুরুষের মত খুন করা হয়।
ভোরবেলা সিপাহি বিপ্লবের ঢেউ গিয়ে লাগে দশম বেঙ্গলে। সিপাহিরা উন্মত্ত হয়ে ওঠে। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা হাজির হয় সেখানে। কিছু সিপাহিকে নিয়ে অফিসার্স মেসে প্রবেশ করেন। তখন পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণে ছিল না কর্নেল নওয়াজিশের। ক্যাপ্টেন আসাদ ও ক্যাপ্টেন জলিল নামক দুই অফিসার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এই কাজে। টেনে হিচড়ে আনা হয় তিনজনকে। তারা তখন সকালের নাস্তা করছিলেন। হুদা ভীত হয়ে পড়েন, খালেদ ছিলেন স্থির, শান্ত, ধীর।
এক বিপ্লবী হাবিলদার চিৎকার করে বলে, “আমরা তোমাদের বিচার করব।“
খালেদ শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, “ঠিক আছে, তোমরা আমাদের বিচার করো। আমাকে জিয়ার কাছে নিয়ে চলো।“
কিন্তু হাবিলদার শুনল না তার কথা, “আমরা এখানেই তোমার বিচার করব।“
খালেদ ধীর স্থির,”ঠিক আছে, তোমরা আমার বিচার করো।“দুহাতে মুখ ঢাকলেন তিনি। শেষে বলছিলেন,
‘দেখো আমার কোনো দোষ নেই-আমি কোনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করিনি- আমি দেশটাকে ভালোবাসি, এটাই হয়তো আমার অপরাধ- তোমরা ভুল করোনা, আমাদের শরীরে এখনো রণাঙ্গনের মাটির গন্ধ রয়েছে…” কথা শেষ করার আগেই গুলি করা হল তাকে।
মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীর লাশ। পৃথিবী সেই মুহূর্তে লজ্জায় দুইভাগ হয়ে যেতে চেয়েছিল মনে হয়।
কর্নেল হুদা আগে থেকেই ভয় পাচ্ছিলেন, কামরার মধ্যেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
কর্নেল হায়দার ছুটে বেরিয়ে গেছিলেন, কিন্তু বিপ্লবীরা তাকে ধরে ফেলে। কিল-ঘুষি মারতে মারতে তাকে নিচে নামিয়ে আনা হয়। তখন এক সৈনিকের গুলিতে তার জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। ঢাকায় গেরিলা অপারেশনের বীর যোদ্ধা এটিএম হায়দার-তার হলো এই নির্মম পরিণতি। এই দায় নেবে কে?
এভাবেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা আর তার হোতা তাহেরের দিকে এই হত্যাকাণ্ডের দায় বর্তায়। তাহেরই ছিলেন এই নির্মমতা পেছনে- এই মতে বিশ্বাস করেন কর্নেল শাফায়াত জামিল, কর্নেল গাফফার, মেজর জাফর ইমাম এবং কর্নেল হুদার স্ত্রী নিলুফার হুদা। খালেদের স্ত্রীও খালেদকে সাবধান করেছিলেন, তাহের খালেদের কিছু করতে পারে। উনি যেন সাবধান থাকেন। খালেদ সেই সতর্কবাণী কানে তোলেননি।
তবে উনারা প্রত্যকেই এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরেকজনের হাত থাকতে পারার সন্দেহও পোষণ করেছেন। তিনি হলেন পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে থাকার সময় খালেদের প্রধান প্রতিদ্বন্দী ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী-যাকে বলা হত ট্যাকটিক্সের জাদুকর ।
মীর শওকত আলী ছিলে যশোর ব্রিগেডের কমান্ডার। অভ্যুত্থানের পর খালেদকে বার বার ফোন করে ঢাকার আসার অনুমতি চাচ্ছিলেন তিনি। তার স্ত্রী খালেদের স্ত্রীর কাছে ফোন করে খালেদকে বোঝানোর অনুরোধ করেন। ত্যক্ত হয়ে খালেদ অনুমতি দিলে ৬ নভেম্বর সসৈন্যে ঢাকায় আসেন মীর শওকত। এসেই দেখেন, জিয়াকে মুক্ত করা হয়েছে। অমনি জিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ান তিনি, জিয়াকে বলেন তাকে উদ্ধার করতেই তিনি যশোর থেকে এসেছেন; খালেদ তাকে হুমকি দিয়েছিল আত্মসমর্পণ না করলে যশোর ক্যান্টনমেন্টে মিগ ফাইটারের হামলা করাবেন। এই ভোল পালটে যাওয়া দেখে চরম বিরক্ত হয়েছিলেন কর্নেল হামিদ।
কর্নেল নওয়াজিশকে ব্যক্তিগত আদেশ দিয়েছিলেন মীর শওকত, খালেদ ও তার সঙ্গীদের মেরে ফেলতে। তার আদেশে ক্যাপ্টেন আসাদ ও ক্যাপ্টেন মনসুর নামক দুই অফিসার তাদের হত্যায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। খালেদের লাশ দেখে মীর শওকত হেসে বলেছিলেন, “হোয়্যার আর দ্য আদার বার্ডস?”
শাফায়াত জামিলসহ ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারী অফিসারদের পরিদর্শনে গিয়ে মীর শওকত বলেছিলেন, “Why try them? Line them up and shoot them like dogs.”
নিলুফার হুদা তার স্বামীহত্যার জন্য কর্নেল তাহের ও ব্রিগেডিয়ার শওকত দুজনের দিকেই আঙ্গুল তুলেছেন।
শাফায়াত জামিল, হালদার আবদুল গাফফার, আমিন আহম্মেদ চৌধুরী, নিলুফার হুদাসহ বেশিরভাগই কর্নেল তাহের ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে দায়ী করেছেন এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের জন্য। জিয়া-খালেদ মৈত্রী হলে তা জাসদ ও তাহের গং এর জন্য ক্ষতিকর হবে, এই ধারণা থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেয়া হয় বলে দাবি করেছেন মেজর জাফর ইমাম। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জিয়ার দূরতম সম্পর্ক আছে এমন মন্তব্যও কেউ করেননি।
কর্নেল হামিদ তার স্মৃতিকথায় একটি ভুল করেছেন। তিনি বলেছেন, দশম বেঙ্গলে বিপ্লবীদের নিয়ে আসেন মেজর জলিল। উনি চলে যাবার পরই হত্যা করা হয় খালেদ ও তার সহযোগীদের। কিন্তু মেজর জলিল ১৯৭৪ সাল থেকে জেলে বন্দী। জিয়া ৭ নভেম্বর তাকে মুক্তি দেন। জলিল ময়মনসিংহ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকা আসেন ৯ নভেম্বর। কাজেই দশম বেঙ্গলে ৭ নভেম্বর ভোরে উপস্থিত হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
এভাবেই খালেদ মোশাররফের মত দেশপ্রেমের উজ্জ্বল মূর্তিকে ভারতের দালাল ট্যাগ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তাহের কখনোই কল্পনা করতে পারতেন কি, কত বড় অভিশাপ এসে পড়েছে তার উপর?
৭ নভেম্বর, সকাল সাতটা।
টু-ফিল্ড রেজিমেন্ট কমান্ড সেন্টার।
সৈনিকদের ভিড় ঠেলে একটি আর্মি ট্রাক শো শো বেগে এগিয়ে এলো। ভেতর থেকে নেমে এলো একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট। কর্নেল হামিদকে বলল,” স্যার, জেনারেল জিয়ার কোথায়? জরুরি ব্যাপার আছে।“
“কী ব্যাপার আমাকে বলো,” বললেন কর্নেল হামিদ।
“স্যার, খুবই জরুরি, উনাকেই বলতে হবে।“
তিনি লেফটেন্যান্টকে নিয়ে গেলেন জিয়ার কাছে।
“Sir, I have come to present you dead body of Khaled Musharraf, Col. Huda and Hyder, sir.”
জিয়া অবাক, খালেদের ডেড বডি? মানে?
“হামিদ, দেখ তো কী ব্যাপার।“
কর্নেল হামিদ দেখলেন, ট্রাকের ওপর খড়ের মাঝে তিনজনের লাশ। তিনি এসে জিয়াকে জানালেন, বললেন, লাশগুলো সিএমএইচে পাঠানোর জন্য। ব্যথিত জিয়া বললেন, “প্লিজ, হামিদ, এক্ষুণি ব্যবস্থা করো।“
এভাবেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশকে সেবা করে যাওয়া ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীরউত্তমের ছুটি হলো দেশসেবার মহান দায়িত্ব থেকে।
(৮)
এক মসনদ, দুই বাঘ
তাহেরের প্ল্যান গড়বড় হয়ে যায় যখন জিয়াকে নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয় বিপ্লবীরা। রাতে ট্রাকভর্তি বিপ্লবী সার্জেন্ট আবু ইউসুফের বাসায় এলে তাহের জিজ্ঞেস করেন, “হোয়্যার ইজ জিয়া?”
নায়েক সিদ্দিকী জবাব দেন, “সব ঠিক আছে। জিয়া সাহেব আপনাকে নিতে পাঠিয়েছেন।“
প্ল্যান ভেস্তে গেছে। তাহের এই হতাশা ব্যক্ত করেন হাসানুল হক ইনুর কাছে।
“তোমরা তো নিজের পায়ে কুড়াল মারলা। খেলা তো হাতের বাইরে চলে গেল। জিয়া হইল কেউটে সাপের মত উচ্চাভিলাষী ক্ষমতালোভী অফিসার। মেজর জিয়াউদ্দীন ঢাকায় থাকলে খেলা ঘুরায়ে দেয়া যাইত।“
ঢাকায় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য মেজর জিয়াউদ্দীন সেরাতে ছিলেন খুলনা।
রাত আড়াইটায় টু-ফিল্ডে জিপে চড়ে আসেন তাহের। জিয়া এগিয়ে গিয়ে শক্ত আলিঙ্গন করেন তাকে,
“থ্যাংক ইউ তাহের, ইউ হ্যাভ সেভ দি নেশন, সেভ মাই লাইফ। নাউ হোয়াটএভার ইউ সে আই উইল মাস্ট ওবে।“
তাহের জিয়াকে বললেন, “সৈনিকদের বারো দফা মেনে নাও, প্রিজনারদের ছেড়ে দাও, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করো।“
জিয়া সবকিছুতেই হাত নেড়ে সম্মতি জানান। তাকে মালা পড়াতে গেলে তিনি তা তাহেরকে পরিয়ে দেন, বলেন, “এটা তোমার প্রাপ্য।“
তাহের জিয়াকে উদ্ধার করেছেন, এমন একটা দাবি করেছিলেন তিনি। কিন্তু জিয়াকে উদ্ধারের জন্য তিনি যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন, তার মূলে ছিল জিয়ার আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। জিয়াকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পেছনে খালেদকে মূলত প্ররোচনা দিয়েছিলেন মেজর ইকবাল আর মেজর নাসির। কিন্তু খালেদ নিজেই চিফ অব স্টাফ হবার পথে হেঁটে সব লেজেগোবরে করে ফেলেন। তিনি ব্যর্থ কূটনীতিতে সময় নষ্ট করেন, তিনি ফারুক-রশিদকে বিদেশে পালানোর পথ করে দেন। জিয়া ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছিলেন, তিনি জানতেন শাফায়াত জামিল বা খালেদের কাছ থেকে অভ্যুত্থান আসবে। লে. কর্নেল ডালিম তাকে অনেকবার সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু নিজের মত করে খেলেছেন জিয়া। এই বিপজ্জনক খেলাতেই একপর্যায়ে নিজেও তালগোল পাকিয়ে ফেললেন তিনি। তাহেরের জালে জড়িএ গেলেন জিয়া।
তাহের খেলা নিজের হাতে আনার আরেকটা চেষ্টা করেন। রেডিও স্টেশন তখনও তার নিয়ন্ত্রণে, জিয়াকে ওখানে নিয়ে যেতে পারলে কব্জা করা যাবে। তিনি জিয়াকে বললেন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে। একটা দীর্ঘ বাগবিতণ্ডা হয় দুজনের মাঝে। একসময় জিয়া এসে সুবেদার মেজর আনিসকে বললেন, “ওকে কোনোভাবে সরিয়ে নিন এখান থেকে। সাবধান, বহু পলিটিক্স আছে।“
রেডিও স্টেশন জিয়ার জন্য নিরাপদ না। এটা বুঝতে পেরে কর্নেল আমিনুল, ব্রিগেডিয়ার শওকত, কর্নেল হামিদ, মেজর মুনীর আর সুবেদার মেজর আনিস রুখে দাঁড়ান। কর্নেল আমিনুল এইসময় বাঁচিয়ে দেন জিয়ার জীবন। তিনি বলেন, প্রয়োজনে রেকর্ডিং যন্ত্র এখানে আনা হবে। তাকে এখান থেকে বাইরে যেতে দেয়া যাবে না।
মীর শওকত সবার সামনেই জিয়াকে বলেন, “জিয়া তুমি জাসদের সাথে যাবেনা।“
তাহের শওকতকে বলেন, “শাট আপ।“
জবাবে মীর শওকত বলেন, “ইউ গেট লস্ট!”
লেগে যায় ঝগড়া। কর্নেল আমিনুল বলে বসেন তাহেরকে,”আপনারাতো ভারতের বি টিম।“
সারাজীবন ভারতের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া তাহেরের খুব লাগে কথাটা। সুবেদার মেজর আনিস এসে তাহেরকে বললেন, “আপনি এখন দয়া করে আসুন।“
তাহের কট্মট করে তার দিকে তাকালেন, “আমাকে চেনেন?”
“জি স্যার আপনাকে চিনি। তবে এখন আমার সাথে আসুন।“
রাগে বিড়বিড় করতে করতে তাহের আবু ইউসুফ ও অন্যান্যদের সাথে নিয়ে টু-ফিল্ড ত্যাগ করলেন। মীর শওকত বলেছেন, আমিনুলের বুদ্ধিমত্তার জন্য বেঁচে গেছিল জিয়া। মেজর হাফিজের মতে, আমিনুল পাশে না থাকলে জিয়ার ভাগ্য জাসদের দয়ায় নির্ধারিত হত। এনাকে পাশ থেকে সরিয়ে দিয়ে বড় ভুল করেছিলেন খালেদ মোশাররফ, জিয়ার শক্তিশালী রক্ষাকর্তা হয়েছিল কর্নেল আমিনুল হক বীরবিক্রম আর তার চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট। তার পরামর্শমতই রেকর্ডিং যন্ত্র এনে জিয়ার একটি ছোট্ট ভাষণ রেকর্ড করা হয়।
৭ নভেম্বর, সকাল দশটা
সাড়ে আটটার দিকে একপাল বিপ্লবী নিয়ে উপস্থিত হলেন কর্নেল তাহের। জিয়ার কামরায় সদলবলে ঢুকে গেলেন তিনি। সাড়ে দশটায় সেখানেই মিটিং বসল। মিটিং জেনারেল ওসমানী, জেনারেল খলিলুর রহমানসহ তিনবাহিনী প্রধানরা ছিলেন। সেখানে তাহের জোরালোভাবে বক্তব্য রাখেন নিজের দাবিদাওয়া নিয়ে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে ওসমানী খন্দকার মোশতাকের নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু জিয়া-তাহের দুজনই প্রতিবাদ করেন। শেষে বিচারপতি সায়েমকেই রাষ্ট্রপতি করা হয়। এখানে তাহের তার বারোদফা নিয়ে কথা বলতে চাইলে সেই সমর্থন করেননি তাকে। জিয়াও এসময় চুপ থাকেন। এই অপমান তাহের ভুলতে পারেননি। জিয়ার নিরবতা তার মনে সন্দেহ জাগায়।
১৫ আগস্টের পর থেকেই শাহবাগ রেডিও স্টেশনের দায়িত্ব ছিল মেজর জুবায়ের সিদ্দিকীর ওপর। তার ভাষ্যে উঠে আসে ক্ষমতার পালাবদলের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৭ নভেম্বর বিচারপতি সায়েম রেডিওতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। সেসময় রেডিও স্টেশনে ছিলেন জিয়া-তাহের দুজনই। বেতারের মহাপরিচালকের কক্ষে বসে জিয়ার সাথে তাহেরে কথা হয়। বেতারের স্টুডিওতে আসার আগেই রাষ্ট্রপতির ভাষণ রেকর্ড করা হয়েছিল, যাতে তাহেরের লোকজন কোনোরকম গোলমাল করতে না পারে ভাষণের সময়। তাহেরের সাথে কথা বলে জিয়া পাশের কক্ষে যান। ওখানে আগে থেকেই ছিল ২০-২৫ জন বিপ্লবী। জিয়া ঘরে ঢুকেই তাদের সাথে খোশমেজাজে হাত মেলালেন, কুশল বিনিময় করলেন। টেবিলের ওপর বসে হাসিমুখে গল্প জুড়ে দিলেন তিনি। একজনকে বললেন সব দাবি-দাওয়া পড়ে শোনাতে। সব পড়া শেষ হলে তিনি বললেন, দাবিগুলো খুবই ন্যায্য এবং তা অবশ্যই পূরণ করা উচিত। জিয়া জাসদ নেতা আসম আবদুর রব আর এমএ জলিলের মুক্তির নির্দেশ দিলেন। ফলে বিপ্লবীদের মধ্যে সমস্ত উত্তেজনা সাথে সাথেই মিলিয়ে গেল।
জিয়া সৈনিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তার এই তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে গেলেন তাহের। একটি সিগারেট ধরিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালে জমে ওঠা ফোঁটা ফোঁটা ঘাম মুছতে মুছতে পাশেই রাখা ক্রাচের মত লাঠিটা দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। বিপ্লবের ফলাফলকে নিজের পক্ষে নেবার শেষ আশাটাও কর্পূরের মত উবে গেল। টু-ফিল্ডের সৈন্যরা চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকল যতক্ষণ না লাঠিতে ভর দিয়ে কর্নেল তাহের তাদের দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে গেলেন।
কিন্তু কর্নেল তাহের এবার ভয়াবহ চাল চাললেন। এবার তিনি সেনানিবাসের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিলেন, যাতে সে আগুনে পুড়ে মরেন জেনারেল জিয়া।
৯
৭ নভেম্বর, টু-ফিল্ড কমান্ড।
বিকেল চারটা।
কর্নেল হামিদ টু-ফিল্ডে এলেন জিয়ার সাথে দেখা করতে। আজকে সারাদিনই জিয়া সবখানে একটা জিপে চড়ে চরকির মত ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিশৃঙ্খল ইউনিটগুলোর কাছে গিয়ে তাদের অস্ত্র জমা দিতে বলেছেন, বলেছেন তাদের সকল দাবি-দাওয়া মেনে নেয়া হবে। কোন কোন ইউনিট কয়েকজন অফিসারের ফাসি চাইছিল, জিয়া বলেছেন পরিস্থিতি শান্ত হলে এটা নিয়ে ভেবে দেখবেন। সারা ঢাকা শহরে সিপাহি-জনতা এক হয়ে মিছিল করছে, শ্লোগান দিচ্ছে। সব মিলিয়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশ শহরজুড়ে। জনতা জাসদের বিপ্লবের কথা জানেনা-সবাই জানে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করেছে সিপাহিরা। এর সাথে যে জাসদ জড়িতে, কেউই জানেনা তা।
এর কারণও আছে। গতরাতে বিপ্লবের পর বেতারকেন্দ্রে থাকা বিপ্লবীরা ঘোষণা দিয়েছিল, জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করা হয়েছে। ভারতপন্থী খালেদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ। সেখানে তাহের বা জাসদের নাম নেয়া হয়নি। পরেরদিন জিয়া যে ভাষণ রেকর্ড করান, সেখানেও সুকৌশলে তিনি বারোদফা বা তাহেরের নাম নেননি। এজন্যই জনতা আঁধারেই রয়ে গেছে।
বারান্দা দিয়ে উঠতেই কর্নেল হামিদ দেখতে পেলেন তাহেরকে। তাহের বিমর্ষমুখে বসে আছেন একটি কক্ষে। মুখ তার কালো, গম্ভীর, ভারি। তিন-চারজন অফিসার বসা তার সাথে। এর মধ্যে আছেন কর্নেল আমিনুল। তাহের সালাম দিলেন কর্নেল হামিদকে।
কর্নেল হামিদ জিজ্ঞেস করলেন,” কী ব্যাপার তাহের? তুমি এত গম্ভীর কেন?”
তাহের উত্তর দিলেন, “স্যার, আপনারা কথা দিয়ে কথা রাখবেন না, মন খারাপ হবে না?”
কর্নেল হামিদ তাহেরের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলেন না। কর্নেল আমিনুল তাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে সব বুঝিয়ে বললেন।
“বুঝলেন না স্যার? ব্যাপারটা তো সব তাহেরের লোকজনই ঘটিয়েছে, এখন জিয়াকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বারগেন করছে। এখনতো সে জিয়াকে মেরে ফেলতে চায়।“
এতক্ষণে কর্নেল হামিদ বুঝলে, ডালমে কুছ কালা হ্যায়। আশপাশে এলোমেলো ইউনিফর্মের এত লোক কেন এখন তিনি সেটা বুঝতে পারলেন। এরা সবাই বিপ্লবী। শঙ্কিত হলেন তিনি।
“তোমার ফোর্থ বেঙ্গল তোমার কন্ট্রোলে আছে তো?”
“অবশ্যই।“
“তাহলে তুমি তোমার লোকজনকে নিয়ে ডিফেন্স পেরিমিটার তৈরি করে সাবধান থাকো। আমার কাছে তো অবস্থা গোলমেলে মনে হচ্ছে।“
“জানিনা স্যার আজরাতে কী হবে। তাহের উল্টাসিধা কথা বলছে। তবে আমার লোকজন ঠিক আছে।“
“এখন টু-ফিল্ডের কী অবস্থা?”
“টু-ফিল্ড তো সুবেদার মেজর কমান্ড করছে। কোনো অফিসার নেই। বিপ্লবীতে ভরে গেছে আশপাশ। দেখছেন না আশেপাশে?”
“জিয়া ভেতরে আছে?”
“স্যার আছেন। আপনি গিয়ে একটু বুঝিয়ে বলুন না। রাতের গণ্ডগোল হতে পারে।“
“হ্যাঁ যাচ্ছি।“
জিয়ার সাথে কথা বলে বাইরে এলেন কর্নেল হামিদ। জিয়া চিন্তিত, বিমর্ষ। সৈনিকদের দাবিদাওয়ার সামনে অসহায় বোধ করছেন তিনি। কর্নেল আমিনুলকে জিয়ার গার্ডে রেখে কর্নেল হামিদ বেরিয়ে পড়লেন বিদ্রোহী ইউনিটগুলোকে ঠান্ডা করতে।
কর্নেল আমিনুল জানালেন, টু-ফিল্ডে বিপ্লবীরা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আজরাতে অফিসারদের উপর আক্রমণ করবে।
বিকেলের মধ্যেই ক্যান্টনমেন্ট খালি হয়ে যেতে লাগল। অফিসাররা পরিবার নিয়ে যেদিকে পারে যেভাবে পারে পালাতে লাগল। গোটা ক্যান্টনমেন্টে বিপ্লবীদের লিফলেট আর প্রোপাগাণ্ডা। সাধারণ সৈনিকরা বিগড়ে গেল সবাই। বিপ্লবীদের বারো-দফার দাবি মেনে না নিলে একজন অফিসারকেও বাঁচিয়ে রাখবে না তারা।
এই আলোচিত বারো-দফায় আসলে কী ছিল-সেটা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। এই বারো-দফার ছিল তাহেরের সেনাবাহিনীতে প্রভাব বিস্তার করার দাবি-দাওয়া। তাহেরের বিপ্লবীরা সংখ্যায় ছিল সামান্য, তাও বেশিরভাগই ছিল সিগন্যালস বা অর্ডন্যান্সের সৈনিক। সশস্ত্র লড়াইয়ে পদাতিক বা ট্যাঙ্কারদের সামনে দাঁড়ানো তাদের পক্ষে কঠিন ছিল। আর তাই তাহের সেনাবাহিনীর দুটো অংশকে টার্গেট করে এই বারো-দফায় নির্দিষ্ট দাবি রাখে।
বারো-দফার দ্বিতীয় দফা ছিল রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। রাজবন্দী বলতে ছিলেন জাসদের নেতাকর্মীরা।
তৃতীয় দফা ছিল রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা না করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। এই দাবিটি সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ছিল। সেনাবাহিনী স্বতন্ত্র দেশরক্ষা প্রতিষ্ঠান, এর রাজনীতিকরণের ফলাফল হত মারাত্মক।
চতুর্থ দফা ছিল অফিসার ও সৈনিকের কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। এটা সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড নষ্ট করে দিত সম্পূর্ণরূপে। শ্রেণিহীন সেনাবাহিনী বাংলাদেশের পটভূমিতে অত্যন্ত অযৌক্তিক একটি বিষয়।
দশম দফা ছিল বিদেশে নির্বাসিত সকল অফিসার ও সৈনিককে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। এটা রাখার মূল উদ্দেশ্যই ছিল বেঙ্গল ল্যান্সার্স, টু-ফিল্ড রেজিমেন্ট আর ৪৪ কুমিল্লা ব্রিগেডের সৈন্যদের সমর্থন লাভ। তাহেরের বিপ্লবীদের প্রয়োজন ছিল শক্তিশালী মিত্র- পনেরো আগস্টের খুনিচক্রকে দেশে ফিরিয়ে আনলে এটা করা সম্ভব হত। অত্যন্ত তিক্ত হলেও সত্য, খুনি ফারুক-রশিদ-ডালিমের বেশ ভালো জনপ্রিয়তা ছিল নিজ নিজ ইউনিটে, আর এটা ব্যবহার করে জিয়ার আমলেও দুইবার অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায় এরা। জিয়াকে বেকায়দায় ফেলার জন্য তাহের খুনিদের সাথে মিত্রতা স্থাপনের চেষ্টা চালান।
এছাড়াও তাহেরের সাথে খুনিচক্রের আতাত হয়েছিল ব্যাঙ্কক যাবার আগে। সেখানে তাহের কথা দিয়েছিলেন, খালেদকে সরানো হলে খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে এবং নির্বাসিত মেজররা পুরনো পদ ফিরে পাবেন। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে তাহের সময় নিয়েছিলেন ৭৫ ঘণ্টা, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বারো-দফায়।
দ্বাদশ দফা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ১৮ মাসের বেতন পাকিস্তান প্রত্যাগতদের বুঝিয়ে দিতে হবে। এর কারণ ছিল সেনাবাহিনীর ৩০ হাজার জনবল ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত, এর মাঝে ১১০০ জন ছিলেন অফিসার। এদের সমর্থনেই ৭ নভেম্বরের বিপ্লব সফল হয়েছিল, কারণ খালেদের সমর্থক ছিল মাত্র দুই-আড়াই হাজার মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তাহের সাফল্যের সাথে ঢাকা সেনানিবাসের আট-নয় হাজার পাকিস্তান প্রত্যাগতকে জিয়ার পক্ষে কাজ করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রত্যাগতদের প্রথম পছন্দ ছিলেন জিয়া।
এই বারো-দফা দাবি নিয়ে জাসদের সাথে কোনো আলোচনা হয়নি। বিপ্লবে জাসদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল নিষ্ক্রিয়। এই অভিযোগ তুলেছিলেন ড. আনোয়ার হোসেন। তিনি তাহেরের ছোট ভাই, ঢাকা মহানগর গণবাহিনীর কমান্ডার। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের লেকচারার। তিনি বলেছেন,৬ নভেম্বর কর্নেল তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে নিয়ে যখন অভ্যুত্থানের সামরিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে ফেলেছেন, তখনো জাসদ নেতৃবৃন্দ ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও গণবাহিনীকে রাস্তায় নামানোর প্রাথমিক প্রস্তুতিও নেননি। সেইসময় আনোয়ার হোসেনের অধীনে ছি ছয়শ নিয়মিত সদস্য। কিন্তু হাসানুল হক ইনুর কাছ থেকে নির্দেশ পাননি তিনি। ইনুর বলেছিলেন, আপাতত গণবাহিনীকে অভ্যুত্থান সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। এ কারণে গণবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডারদের পর্যন্ত কিছু জানানো যায় নি।অথচ তাহেরকে জানানো হয়েছিল, জাসদের সবাই মাঠে থাকবে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি সহকারে। অথচ জাসদের নেতারা কার্যত কিছুই করেননি।
জাসদের এই ধরি মাছ না ছুঁই পানি পলিসির জন্য তাহেরের বিপ্লব অনেকটা ক্যান্টনমেন্ট নির্ভর হয়ে যায়, যেখানেও সাধারণ সৈনিকরা জানত এ বিপ্লব হবে জিয়াকে মুক্ত করার জন্য। বিপ্লবীদের দাবি বা আদর্শ নিয়ে কোনো ধারণাই তাদের ছিল না। এ কারণেই জিয়ার প্রতি ছিল তাদের আনুগত্য।

বিপ্লবীদের ১২ দফা
কর্নেল হামিদ ঢাকার স্টেশন কমান্ডার। তিনি ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালাতে রাজি হলেন না। বললেন,” আমি স্টেশন কমান্ডার। আমি ভয়ে পালিয়ে গেলে কীভাবে হবে?”
তার স্ত্রী প্রখ্যাত দাবাড়ু রানী হামিদ। তিনি বললেন, “তুমি রয়ে গেলে আমরাও থাকব। মরলে একসাথে মরব।“
তার পরিবারও রয়ে গেল। নিজের বিশ্বস্ত কিছু সৈনিক নিয়ে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করলেন তিনি। সারা ক্যান্টনমেন্টজুড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি। বাতাসে অশুভ ইঙ্গিত, চারদিক নিস্তব্ধ।
১০
দুঃস্বপ্নের ছত্রিশ ঘণ্টা
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরেই বেঙ্গল ল্যান্সার্সের ট্যাঙ্ক এলো ফোর্থ বেঙ্গলের লাইনে। তারা চাপ দিতে লাগল কর্নেল গাফফার আর মেজর নাসিরকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য। এ দুজন আশ্রয় নিয়েছিলেন ফোর্থ বেঙ্গলে। ফোর্থ বেঙ্গলের লাইনের রিকয়েললেস রাইফেল আর হেভি মেশিনগান বসানো হয়েছি প্রতিরোধের জন্য, এই প্রতিরক্ষাব্যুহে ট্যাঙ্ক নিয়ে ঢুকলেও ফেরত যেতে পারবে না। কর্নেল আমিনুল আর মেজর মুনীর জোর লড়াই করে ফিরিয়ে দিলেন ল্যান্সারদের। খুনে ট্যাঙ্কারদের কাছ থেকে রক্ষা পান কর্নেল গাফফার আর মেজর নাসির। উনাদের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে এই কাহিনী।
রোজ কেয়ামত নেমে এলো রাত বারোটার পর। সৈনিকরা অফিসারদের রক্তের নেশায় পাগল হয়ে ওঠে। সৈনিকরা মেজর করিমকে হত্যা করে। এয়ারপোর্টে আক্রমণ করে মেজর আজিম ও মেজর মুজিবের ওপর। মেজর মুজিব পালাতে পারলেও মেজর আজিম আর মিসেস মুজিব মারা যান। উনারা যাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম।
অফিসার্স মেসে হামলা করে তিনজন অফিসারকে হত্যা করা হয়, এর মাঝে ছিলেন মেজর মহিউদ্দীন। তিনি বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফন করেছিলেন।
বনানীতে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরীর বাসায় হামলা করা হয়, তিনি পালাতে পারলেও মারা যান মিসেস ওসমান।
হকি খেলতে এসেছিলেন দুই তরুণ অফিসার- ক্যাপ্টেন আনোয়ার আর লেফটেন্যান্ট মুস্তাফিজ, তাদের স্টেডিয়ামের পাশে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অডর্ন্যান্স স্টেটে দশজন অফিসারকে লাইনে দাঁড় করানো হয়, এদের মধ্যে এক ক্যাপ্টেনকে গুলি করে মারা হয়। পরে বাকিরা অনুয়ন-বিনয় করলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
লেডি ডাক্তার হামিদাকে বিনাকারণে মেরে ফেলা হয়।
মেডিক্যাল কোরের ব্রিগেডিয়ার খুরশিদকে চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছিল মেরে ফেলার জন্য। এমন সময় অসুরের শক্তি এসে ভর করে উনার দেহে, দৌড়ে পালিয়ে যান তিনি।
বঙ্গভবনে খালেদ মোশাররফের সময় খুব অ্যাকটিভ ছিলে বিটিভির কর্মকর্তা মুনিরুজ্জামান। তাকে ধরে নিয়ে গুলি করা হয়। তিনদিন পর তার লাশ পাওয়া যায় মতিঝিল কলোনির ডোবা থেকে।
কর্নেল হামিদের ঘরে হামলা করে বিপ্লবীরা। রানী হামিদ প্রবল সাহসে দরজা খুলে মুখোমুখি হন বিপ্লবীদের, তাকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় তারা। একপর্যায়ে তাকে গুলি করতে উদ্যত হলে কর্নেল হামিদ বেরিয়ে আসেন, তাকে গুলি করার জন্য রাইফেল তাক করে বিপ্লবীরা। কর্নেলের অনুগত সৈনিকরা ধস্তাধস্তি করে বাঁচিয়ে দেয় তাকে।
আবু ওসমান চৌধুরী প্রথম আলোতে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “সেদিন জওয়ানদের বলা হয়েছিল সব অফিসারদের হত্যা করো। থাকবে শুধু জিয়া আর তাহের। একারণে জওয়ানেরা অফিসারদের হত্যা শুরু করে। অনেক অফিসার সেদিন বোরখা পরে পালিয়ে গেছিলেন।“
এভাবে এক একে বারোজন মারা যান ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর ক্যান্টনমেন্টেও চলে এই হত্যাযজ্ঞ। বিপ্লবীদের হাতে মারা যান মোট ৪০ জন অফিসা্র।
এ নিয়ে হাসানুল হক ইনু অত্যন্ত রূঢ় এবং নিষ্ঠুর মন্তব্য করেছিলেন দৈনিক আমাদের সময়কে দেয়া সাক্ষাতকারে, “সেদিনের অফিসার হত্যা ছিল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।“
অধিকাংশ অফিসারই ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে গেছিলেন। ভোর হতেই যারা ছিলেন তারা পালানো শুরু করলেন। কেউ বোরখা পরে, কেউ শাড়ি পরে পালিয়ে গেলেন। যারা রয়ে গেলেন বিপ্লবীরা তাদের কাঁধের র্যাঙ্ক ছিড়ে ফেলল। অফিসারদের লাঞ্ছিত করা হচ্ছিল, তাড়া করা হচ্ছিল, আঘাত করা হচ্ছিল। অমানুষিক শক্তির বলে জিয়া ক্যান্টনমেন্টে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে থাকেন। বিপ্লবীদের দাবি মোতাবেক ৮ তারিখে এমএ জলিল আর আসম আবদুর রবকে জেলখানা থেকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি পান শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ শাহজাহানও। বেলা দশটার দিকে সৈনিকদের এক বিশাল সমাবেশে জিয়া আবেগময় কণ্ঠে হাতিয়ার জমা দেয়ার আহবান জানান। এক সিপাহি নেতা জিয়াকে সম্বোধন করে বলল,’জনাব জিয়াউর রহমান…”
জিয়া সাথে সাথে ধ্মক দিলেন, “আমি জনাব জিয়া নই, আমি জেনারেল জিয়া।“
আর্মি হেডকোয়ার্টারে জিয়া পরাভূত সেনাপতির মত ক্লান্ত, বিধস্ত হয়ে বসে রইলেন। তার পাশে নেই কেউ। সব কিছু ভেঙে পড়েছে জিয়ার চারপাশে। তাহের আর বিপ্লবীরা সব দখলে নিয়েই যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কোথায় পাবেন তিনি আশা্র বাণী? হেডকোয়ার্টারে নেই কেউ, সব অফিসাররা পালিয়েছে। তাহের চান শ্রেণিহীন সেনাবাহিনী। একটি বিপ্লবী কাউন্সিলের হাতে থাকবে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা। এভাবে ভেঙে পড়বে সেনাবাহিনী। বাস্তবতা উপলব্ধি করেই জিয়া মেনে নিতে পারেননা এসব দাবি। তাহের কি মগের মুল্লুক পেয়েছে? সেনাবাহিনীর কোমর ভেঙে যাবে তো তাহেরের কথা মেনে নিলে।
জিয়া কখনো হার মানেননি, কখনোই না। যখন বঙ্গবন্ধু তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তখনো না। যখন মোশতাক ওসমানীকে দিয়ে জিয়ার ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন, তখনো না। এখন কি হার মানতেই হবে তার?
৭ তারিখের সকালবেলা যে জিয়া ছিলেন বিজয়ী সম্রাট, আট তারিখের সকালেই তিনি হয়ে গেছেন এক মুকুটহীন পরাজিত সম্রাট- হাজারো সমস্যায় জর্জরিত, মুক্তির কোনো নাম-নিশানাও নাই কোনোদিকে।
৮ তারিখ বায়তুল মোকাররমের সামনে জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক জোট,কৃষক লীগ ও গণবাহিনীর এক সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের একটি মিছিল চারটার সময় সমাবেশস্থলে পৌঁছায়। জিয়ার নির্দেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে এই সমাবেশ পণ্ড করে দেয়। এর পরপরই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা সমাবেশ স্থলে এসে পুলিশকে হটিয়ে দেয়। পরে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে মিছিল বের হয়ে শহিদ মিনারে শেষ হয়।
৮ তারিখেই ঢাকা সে্নানিবাসের মাঠে জিয়া সব সৈনিকদের একত্রিত করেন। সকাল দশটায় সশস্ত্র সৈনিকেরা একত্রিত হয়, অফিসাররা ছিলেন নিরস্ত্র। জিয়া সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা যার যার ইউনিটে গিয়ে যার যার আর্মস ইউনিট কমান্ডারের কাছে জমা দিয়ে যার যার কাজে যোগ দিন।“
অফিসারদের বলেন তিনি, “আপনারা যার যার র্যাঙ্ক লাগিয়ে যার যার কমান্ডে চলে যান।“
বেলা একটায় এলিফ্যান্ট রোডে সার্জেন্ট আবু ইউসুফের বাসায় তাহেরের সাথে দেখা করতে যান নায়েব সুবেদার মাহবুব। তিনি দেখেন তাহের টেলিফোনে আলাপ করছেন। কথা শেষ হতেই তিনি সজোরে নামিয়ে রাখলেন টেলিফোনটি, বললেন, “ব্রিটেয়ার!”
“স্যার, কে?”
“জেনারেল জিয়া। সুবেদার সাহেব, এক কাজ করেন, আপনি আপনার সুইসাইড কমান্ডো ফোর্স তৈরি করেন গাদ্দার জিয়াকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য।“
“স্যার, এখন মোটেই সম্ভব নয়। কী বলে সিপাহিদের একত্র করব? আমরা কী জন্য কী উদ্দেশ্যে সিপাহি-জনতার বিপ্লব করেছি তার কোনো কিছুই প্রকাশ হয়নি।“
এই এক কথায় সুবেদার মাহবুব পরিষ্কার করে দিলেন কেন ব্যর্থ হয়েছিলেন কর্নেল তাহের। জিয়ার সফলতা মূল কারণ তাহেরের ভুল, তাহেরের মিসকমিউনিকেশন। তাহের চোখ বুজে ছেড়ে দিয়েছিলেন বিপ্লবটা, ফলাফল বিশৃঙ্খলা আর রক্তপাত- যা বিপ্লবটিকে ব্যর্থতায় ডুবিয়ে দেয়।
অশেষ উদ্দীপনায় কাজে নেমে পড়েন জিয়া। নয় তারিখ ঢাকা গ্যারিসন সিনেমা হলের সামনে এক সমাবেশে জিয়া ঘোষণা করেন, “কোনো অফিসারকে হত্যা করার আগে যেন আমাকে হত্যা করা হয়। কারণ আমিও একজন অফিসার।“
অফিসারদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন,” Don’t run away like cowards. If you run, they will chase you. Behave like officers and save the nation.”
জিয়ার এ ভাষণ ম্যাজিকের মত কাজে দেয়। উপস্থিত সৈনিকরা অস্ত্র জমা দিতে রাজি হয়।
জিয়ার উদাত্ত আহবান কাজে দেয়। এক সপ্তাহের মধ্যে নিজেকে নিরাপদ করে ফেলেন তিনি।
নিজের অসীম ক্যারিশমা আর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে সব নিয়ন্ত্রণে আনেন তিনি। এরই মধ্যে ঢাকা ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত হন কর্নেল আমিনুল হক, নিজের আনুগত্যের পুরস্কার পান তিনি। ঢাকা সেনানিবাসের লগ এরিয়া কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় কর্নেল হামিদকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্নেল হামিদ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে শুরু করেন। ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী নিজের অবস্থা সুসংহত করে নেন জিয়ার পাশে। তিনি সিজিএস হবার পর সেনা গোয়েন্দাসংস্থাকে সক্রিয় করে তোলেন দ্রুততার সাথে। খুলনা থেকে লে. কর্নেল আবদুস সালামের নেতৃত্বে দ্বাদশ বেঙ্গলের কমান্ডো নিয়ে আসেন জিয়া। ৯ তারিখ সকালে আরেকটা পদাতিক ব্যাটালিয়ন উপস্থিত হয়। এভাবে নিজের অনুগত অফিসারদের নিয়ে চারপাশে এক শক্তিশালী বলয় গড়ে তুলতে সক্ষম হন জিয়া। আর্থিক সুযোগসুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা দিয়ে বিপ্লব স্তিমিত করা হয়।
তাহেরের পরিকল্পনাহীন বিপ্লবের মুখে ছাই দিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসেন সদা সানগ্লাসের ভেতর নিজের ইমোশন লুকিয়ে রাখা সাবেক মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান। শুরু হয় তার ঝঞ্ঝা বিক্ষুদ্ধ পাঁচবছরের শাসনকাল, বহুবার যা রঞ্জিত হয়েছে মানুষের রক্তে।
ক্ষমতায় বসে তার প্রথম কাজ হয় বিপ্লবকে দমন করা।
১১
নির্বাপিত অগ্নিশিখা
জাসদ নেতাদের এক গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৫ নভেম্বর রায়েরবাজারের এক কাঠের আড়তে। সবার এক কথা- জিয়া বিট্রে করেছে। জিয়ার বিট্রেয়ালটা কেন এলো, সেটা ভাববার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করছেন না।
মেজর জলিল বললেন, “ভয়ের কোনো কারণ নেই। বঙ্গভবনের সামনে যেসকল ট্যাঙ্ক আছে আমার সঙ্গে কথা বলে গেছে।“
নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে জলিল সাংবাদিক আমানউল্লাহের কাছে জিয়ার সম্পর্কে ক্ষোভ ঝাড়েন। তিনি বলেন, “দ্যাট বাস্টার্ড হ্যাজ বিট্রেড।“
২৩ তারিখ সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন জিয়া। সাথে সাথেই তিনি এলিফ্যান্ট রোডের শাজাহান সিরাজের বাসা থেকে গ্রেফতার করেন রবকে। একই দিনে গ্রেফতার করা হয় জলিল, ইনু আর সার্জেন্ট আবু ইউসুফকে। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলে বিপ্লবীদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের আবাসিক শিক্ষক ও পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার মোস্তফা সারোয়ার বাদলের বাসায় মিটিং করছিলেন তাহের। সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় কর্নেল তাহেরকে। গ্রেফতার হবার পর তাহেরের মনে হয়, ৭ নভেম্বর যাদের ক্ষমতায় এনেছিলেন তিনি, তারা বেঈমানি করেছে।
জাসদ বুঝতে পারে, বিপ্লব হাতছাড়া হয়ে গেছে। এরপর এমন একটা ঘটনা ঘটে, যাতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বই হুমকির মুখে পড়ে যায়।
ঢাকা শহরের গণবাহিনী কমান্ডার ছিলেন কর্নেল তাহেরের ভাই আনোয়ার হোসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের লেকচারার। তিনি ছয়জনের একটা দল তৈরি করেন। এই সুইসাইড স্কোয়াডের কাজ ছিল ভারতের হাইকমিশনার সমর সেনকে অপহরণ করে তাহেরের মুক্তিসহ আরো কিছু দাবি-দাওয়া পূরণ করা। দলের সদস্যরা ছিলেন তাহেরের দুই ভাই সাখাওয়াত হোসেন বাহার, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, মীর নজরুল ইসলাম বাচ্চু, মাসুদুর রহমান, হারুনুর রশীদ ও সৈয়দ বাহালুল হোসেন সবুজ।
তিতুমীর কলেজের ছাত্রসংসদের সভাপতি কামালউদ্দীন আহমেদ এই অভিযানের জন্য মগবাজারের একটি বাড়িতে শেল্টারের ব্যবস্থা করেছিলেন। এখান থেকেই দলটি ২৬ তারিখ সকালে রওনা হয়।
২৬ নভেম্বর, ১৯৭৫।
ধানমন্ডি দুই নম্বরে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনে হাজির হয় সবাই। দলের নেতা বাহার। তিনজন অবস্থান নেয় রাস্তার ডান পাশের জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের চত্বরে। তিনজন অপেক্ষা করতে থাকে ভারতীয় ভিসা অফিসের সামনে। সকাল সাড়ে নয়টায় সমর সেন গাড়ি থেকে নামলেন। ওমনি বাহারদের দুইজন তার দুই হাত ধরল।
“আপনি এখন আমাদের হাতে জিম্মি। আপনার ঘরে চলুন। আপনার সাথে আমাদের কিছু কথা আছে।“
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে যাবার পথে ওপরের থাকা ভারতীয় গার্ডরা ব্রাশফায়ার করেন। ঘটনাস্থলে বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুন নিহত হয়। হাইকমিশনারের কাঁধে গুলি লাগে।
আগেরদিন রেকি করার সময় কতজন গার্ড কোথায় ডিউটি করে তা জেনে গেছিল ওরা। কিন্তু দোতলায় একদল গার্ড থাকে তা ওদের জানা ছিল না।
খবর পেয়ে সাথে সাথেই এলেন সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল এম এ মঞ্জুর। তিনি আহত বেলাল আর সবুজকে তার গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলেন সিএমএইচে। বাকিদের লাশ তিন নম্বর রোডের থানার পোর্টিকোতে ফেলে রাখা হয়।
এর ফলাফল হয় মারাত্মক। ভারতের সাথে বঙ্গবন্ধুর করা মৈত্রীচুক্তি তখনো বলবত। এমন অবস্থায় ভারতীয় হাইকমিশনে আক্রমণ করার ফলাফল হতে পারত ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের আগ্রাসন। প্রায় একই পদ্ধতিতে ১৯৭৫ সালেই ইন্দিরা গান্ধী দখল করে নিয়েছিলেন সিকিম। একই পরিণতি হয়ত বাংলাদেশ বরণ করত না, কিন্তু দেশটি ভারতের অধীনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়তে পারত। এ কাজটি আনোয়ার হোসেন কেন করেছিলেন, কার প্ররোচনায় করেছিলেন, তা অজানাই রয়ে গেছে।
এমন ভয়াবহ পরিকল্পনার কথা জানতেন না জাসদের কোনো নেতাই। সিরাজুল আলম খানের সাথে সবসময় পার্টির যোগাযোগ থাকত না।সংযোগ রক্ষার কাজ করতেন শরীফ নূরুল আম্বিয়া। তিনি দুপুরে আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে সব শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। পার্টি ফোরামের সদস্য বিধানকৃষ্ণ সেন আম্বিয়াকে ফোন করে বলে, “হঠকারিতা করে পার্টিকে ফাঁসানোর জন্য এই কাজ কে করল?”
ঢাকা মহানগরের গণবাহিনী কমিসার ছিলেন রফিকুল ইসলাম। ঘটনার সময় তিনি বসে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের মাঠে। এই খবর শুনে তিনি ভাবতে থাকেন, এত বড় একটা জিনিস তার অজান্তে কীভাবে হল?
বেরাইদের এক গ্রামে জরুরি মিটিং বসে জাসদের। এখানে আনোয়ার হোসেন সব দায় মাথা পেতে নেন। উনাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও পরে লঘু দণ্ড দেয়া হয়। তাকে কেবল তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। কারণ এত বড় একটা সিদ্ধান্ত সিরাজুল আলম খানের কথা ছাড়া হতে পারে বলে কেউ মনে করেননি।
এরপর জাসদের নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে সরকারের খড়গ। সবাই গা ঢাকা দিতে চাইলেন, কিন্তু তবুও এঁকে এঁকে ধরা পড়লেন আখলাকুর রহমান, মাহমুদুর রহমান মান্না, মোহাম্মদ শাহজাহানসহ নেতারা। দশ হাজার নেতাকর্মী আটক হন। কার্যত শেষ হয়ে জাসদের বিপ্লব। ১৯৭৬ সালে জাসদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিয়ে বিপ্লবের ইতি টানা হয়। পৃথিবীর আর কোনো বিপ্লবী দল নিজেই নিজেকে বিলুপ্ত করে ফেলেছে- এমন নজির নেই আর।
৬ ডিসেম্বর তাহেরকে হাতকড়া পরিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে রাজশাহী কারাগারে সরিয়ে নেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ জুন তাহেরসহ ৩৩জনের বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। এর মধ্যে গোলমাল দানা বাঁধে অন্যখানে।
তাহেরের বারোদফার মাঝে দশ নাম্বার দফা ছিল বিদেশে নির্বাসিত খুনিচক্রকে দেশে ফিরিয়ে আনা। কারণ সেনাবাহিনীতে তখনো ফারুক-রশিদ-ডালিমের অনুগত অনেক ইউনিট ছিল। পাকিস্তান প্রত্যাগতদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল এরা। বারোদফা বাস্তবায়নের ধুয়া তুলে ফারুক-রশিদ দেশে ফেরার জন্য জোর লবিং শুরু করে। সরকার রশিদকে সপরিবারে এবং শুধু ফারুকের স্ত্রীকে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়। ফারুকের সাথে রশিদ দেখা করে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে। তখন ফারুক জানতে পারে দেশের হালহকিকত। ঢাকায় আসার পূর্বে লন্ডনে আবারো দেখা হয় দুজনের- সেবার তাদের সাথে ছিলেন মোশতাক সরকারের আমলে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াব। তিনিই দুইজনকে জানান, বেঙ্গল ল্যান্সার দুইভাগ হয়ে একভাগ সাভার আরেকভাগ বগুড়ায় অবস্থান করছে। টু-ফিল্ড আছে ঢাকাতেই, হয়তো জিয়াকে মুক্ত করেছিল বলেই এই দয়া দেখানো হয়েছে।
লিবিয়ার বেনগাজীতে উপস্থিত হয় ফারুক-রশিদ। সেখান থেকেই রশিদ আসে ঢাকায়, ফারুক চলে যায় সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুর থেকে ফারুক রিসালদার মোসলেহউদ্দীনের সাথে মিলিত হয়। ঠিক করা হয়, রশিদ ঢাকায় গিয়ে যোগাযোগ করবে টু-ফিল্ড আর বগুড়ায় ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের সাথে। প্ল্যানমাফিক রশিদ নতুন অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে।
২৫ এপ্রিল, ১৯৭৬।
ফারুক সদলবলে দেশে ফিরে। দেশে ফিরেই সে চলে যায় সাভারে, সাভারের বেঙ্গল ল্যান্সার রেজিমেন্ট গলায় মালা দিয়ে বরণ করে নেয় তাদের প্রিয় কমান্ডারকে, বাতাসে শোর তোলে ট্যাঙ্কাররা-“কর্নেল ফারুক জিন্দাবাদ!”
২৭ তারিখ বগুড়ায় শুরু হয় বিদ্রোহ। ফারুক ইউনিফর্ম পরে চলে যায় বগুড়া। ট্যাঙ্কগুলোকে ঢাকায় আনার জন্য প্রচেষ্টা শুরু হয়। এদিকে রশিদকে ঢাকায় হাউজ অ্যারেস্ট করা হয়। ফারুক চলে যাবার পরপরই সাভারে শুরু হউ উত্তেজনা। জিয়া ফারুকের পিতামাতাকে হেলিকপ্টারে করে বগুড়া পাঠান। তাদের পীড়াপীড়িতেই ফারুক হেলিকপ্টারে করে বগুড়া ত্যাগ করে। এমন আচরণে ট্যাঙ্কারদের মাঝে নেমে আসে হতাশা। ভেঙে যায় তাদের মনোবল। শেষ হয়ে যায় আরেকটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান। রশিদকে কারাগারে পাঠানো হয়। অনেক সৈনিককে ফাঁসি দেয়া হয়, অনেককে কারাগারে বন্দী করা হয়।
২১ জুন, ১৯৭৬।
কর্নেল তাহেরসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা শুরু হয়। মামলার শিরোনাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম মেজর জলিল ও অন্যান্য’। অভিযুক্তদের মাঝে ১৬ জন ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্য। এই মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন কর্নেল তাহের, মেজর জলিল, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব, সার্জেন্ট আবু ইউসুফ, হাসানুল হক ইনু, আখলাকুর রহমান, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, আনোয়ার হোসেন, সার্জেন্ট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম সালেহা বেগম প্রমুখ। সালেহা বেগম ছিলেন একজন যশোর জেলা ছাত্রলীগের সভানেত্রী। মেজর জলিলের অধীনে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছিলেন তিনি। কর্নেল ডি এস ইউসুফকে চেয়ারম্যান করে পাঁচ সদস্যের সামরিক আদালত গঠন করা হয়। কর্নেল ইউসুফ ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার, তাহের দাবি করেছিলেন তার বিচার যেন কোনো মুক্তিযোদ্ধা করেন।
আদালত বসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে। প্রতিদিনই গোলমাল হতে থাকে কারাগারে। সার্জেন্ট রফিকুল ইসলাম বিচারকের উদ্দেশ্যে জুতা ছুঁড়ে মারেন। দু-তিন দিন পর এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। আখলাকুর রহমান সার্জেন্ট রফিককে ডেকে বলেন, “অবা, কর্নেল তাহেরের তো ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট অইব।“
রফিকুল ইসলাম হতবাক, এ ধরনের মামলায় তো এ সাজা হতেই পারে না! তাহেরকে যে অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়, সে আইনে মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধানই দেশের আইনে ছিল না। তাহেরের ফাঁসির দশ দিন পর আইন মন্ত্রণালয় এই অসঙ্গতি দূর করে।
আখলাকুর রহমানকে জনৈক ফকির এই ভবিষ্যৎবাণী শুনিয়ে গেছিলেন। ১৭ জুলাই তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। একই সাথে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় মেজর জলিল আর সার্জেন্ট ইউসুফকে।কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে এদের বিশেষ অবদানের কথা চিন্তা করে পরে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। তাহেরের পক্ষে তার স্ত্রী লুতফা তাহের রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেন, কিন্তু এ আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়।
২১ জুলাই ভোর চারটেয় কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হয়। রাতে তাকে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। তিনি সহজভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যখন এক মৌলভী তাকে তওবা করাতে আসেন, তিনি তাকে বলেন, “আমি কোনো পাপ করিনি। আপনাদের সমাজের কোনো পাপ আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি; আমি পুরোপুরি সৎ ছিলাম এবং এখনও আছি। আপনি যান, আমি এখন ঘুমাব।“
রাত তিনটেয় তাকে উঠানো হয়। তিনি শেভ করেন। এরপর আম কেটে দিতে বললেন সেলের সহবন্দীদের। তিনি খুব চমৎকার একটা শার্ট পরলেন, হাতঘড়ি পরলেন এবং চুল আঁচড়ালেন। চা, আম আর সিগারেট খেয়ে তিনি শান্তভাবে ফাঁসির মঞ্চের দিকে অগ্রসর হলেন।
তার শেষ ইচ্ছে ছিল দেশেরসাধারণ মানুষের সুখ। এরপর আবৃত্তি করলেন জিয়াউদ্দীনের লেখা একটি কবিতা। কবিতাটির কয়েকটি লাইন হলো-
জন্মেছি সারা পৃথিবীকে ঝাকুনি দিতে
দিয়েই গেলাম।
জন্মেছি সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে,
কাঁপিয়ে গেলাম।
জন্মেছি তোদের বুকে পদচিহ্ন আঁকব বলে,
এঁকেই গেলাম।
জীবনে মরণে বীর কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম সাহসের মূর্ত প্রতীক হিসেবে নিজ হাতে গলায় ফাঁসির দড়ি পরে নেন। তার মৃত্যুর মাধ্যমেই শেষ হয় বাংলাদেশে বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের শেষ আশার আলোটুকু। পরিহাসের বিষয় হলো, কর্নেল তাহেরই সবচেয়ে বেশি আশা দেখিয়ে নিজহাতে মাটিচাপা দিয়েছিলেন মাত্র চার বছরের মধ্যে তারুণ্যের অসীম দ্রোহ বুকে নিয়ে উঠে দাঁড়ানো এক বিপ্লবের। তার মৃত্যুর পর আজ অবদি জাসদ উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
তাহেরের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। অনেক ক্ষেত্রেই বিচারপ্রক্রিয়া ছিল অস্বচ্ছ। কিন্তু জিয়া এখানে ছিলেন নিরুপায়। ৭ ও ৮ নভেম্বরের তাণ্ডবের হোতা তাহেরকে বাঁচিয়ে না রাখার সিদ্ধান্ত এসেছিল সেনাবাহিনীর সকল শীর্ষস্থানীয় অফিসারদের কাছ থেকেই। ৪৯ জন শীর্ষ অফিসার একজোট হয়ে জিয়ার উপর চাপ দিয়েছিলেন তাহেরকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য। টালমাটাল সময়ে জিয়ার হাতে আর উপায় ছিল না কোনো। জিয়াকে চাপ দিচ্ছিলেন প্রায় সকল মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মঈনুল হোসেন চৌধুরী। এই কথাগুলো জেনারেল আমীন আহম্মদ চৌধুরী তার লেখায় উল্লেখ করেছিলেন। জিয়ার প্রধান লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। সবারই কথা ছিল, সেনাবাহিনীর কোমর ভেঙে দেয়া তাহেরকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। জিয়া তাহেরের মার্সি পিটিশন গ্রহণ করার ইচ্ছে রাখতেন- এমনটাই তিনি জানিয়েছিলেন লুতফা তাহেরকে। মীর শওকত আলীকেও তিনি এমনটা বলেছিলেন। কিন্তু তাহের মার্সি পিটিশন করেননি। লুতফা তাহের করেছিলেন কিন্তু তা রাষ্ট্রপতি সায়েম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। জিয়া অকৃতজ্ঞ ছিলেন না, কিন্তু তার আশপাশের সবাই ধরেই নিয়েছিলেন তাহেরের বেঁচে থাকা মানে সেনাবাহিনীর মৃত্যু। তাই সেনাবাহিনীর অফিসারদের সর্বসম্মতিতেই জিয়াকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। এটি জিয়া স্বীকার করেছিলেন মেজর জলিলের কাছে।
১৯৭৬ সালের একদিন পিজি হাসপাতালে মেজর জলিল চেপে ধরেন জিয়াকে, “হোয়াই ডিড ইউ হ্যাং তাহের?”
জিয়া অপ্রস্তুত হয়ে যান। একটু চুপ করে থেকে বলেন, “আমার হাতে অপশন ছিল না, প্রচুর চাপ ছিল আমার ওপর। “
তাহেরের ফাঁসি নিয়ে বাংলাদেশের কোনো বুদ্ধিজীবী মাথা ঘামাননি। তাহেরকে নিয়ে কবি অসীম সাহা একটা কবিতা লিখেছিলেন, যার কয়েক লাইন ছিল এরকমঃ
তাহের তাহের বলে ডাক দিই
ফিরে আসে মৃত্যুহীন লাশ
কার কণ্ঠে বলে ওঠে আকাশ বাতাস
বিপ্লব বেঁচে থাক তাহের সাবাশ।
জিয়া ছিলেন বিদ্রোহ দমনে বজ্রকঠিন। তার শাসনামল ছিল রক্তে রাঙানো। জিয়া শান্তিতে এক বছরও শাসন করতে পারেনি। ছোটবড় একুশটি বিদ্রোহ সামলাতে হয়েছে তাকে। অবশেষে লে. জেনারেল মঞ্জুর ১৯৮১ সালের ৩১ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে হত্যা করেন জিয়াউর রহমানকে। তবে এ বিদ্রোহের পেছনে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের হাত থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ এরপরই মঞ্জুরকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়। জিয়াহত্যার অভিযোগে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১৩ জন অফিসারকে- এদের মধ্যে ছিলেন লে. কর্নেল নওয়াজীশ। নওয়াজীশের কবরের এপিটাফে তার স্ত্রী এমন একটা লাইন লিখে গেছেন, যা এখনো আমাদের রক্ত হিম করে দেবে।
বাংলাদেশের মাটিতে সকল অন্যায়ের বিচার একদিন হবেই, প্রিয়।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এমন সব অফিসার উপহার দিয়েছিল, যারা ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যমণি। উপমহাদেশের সামরিক ইতিহাস পড়াতে গেলে কখনোই কেউ মুছে ফেলতে পারবে না জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের বা এম এ জলিলের নাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দেশকে দিয়েছিল রাজনীতি সচেতন একদল মানুষকে- যারা সকলেই ছিলেন সদ্য রণাঙ্গন ফেরত বিপ্লব। একাত্তরের বিপ্লব আসলে বেহাত হয়ে গেছিল দেশি বিদেশি নানাবিধ চক্রান্তে। সদ্য স্বাধীন দেশে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার মাঝে ছিল অনেক ব্যবধান। সেই সময় সবাই দেশটাকে নিজের মত করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আমরা কখনোই কি প্রশ্ন তুলতে পারব- একজন জিয়া বা একজন খালেদ বা একজন তাহের বা একজন জলিল বা একজন জিয়াউদ্দীন বা একজন শাফায়াতের দেশপ্রেম কম ছিল? না, কখনোই না। বরং তারা দেশকে আমাদের চেয়ে বহুগুণে ভালোবাসতেন বলেই দেশটাকে, দেশের মানুষকে একটা সুন্দর ভবিষ্যত দিতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু ইতিহাস বড়ই নির্দয়। জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছিলেন, ভালো মুদ্রাকে বাজার থেকে তাড়িয়ে দেয় খারাপ মুদ্রা। একইভাবে চৌকস দেশপ্রেমিকদের সরিয়ে দেশ চলে গেছিল বিশ্বাসঘাতক মোশতাক বা বিশ্ববেহায়া এরশাদের হাতে। নানা কাদা, না পাকের মাঝে পড়ে বিতর্কিত হয়েছেন লড়াকু মুক্তিযোদ্ধারা। এখন আমরা ভাবতেই পারি, ১৯৭৩ সালে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল ওয়াসিউদ্দীনকে করা হলে দেশের ইতিহাস কেমন হতে পারত।
নভেম্বরের অগ্নিশিখা শুধু দেশপ্রেমিকদেরই পোড়ায়নি, পুড়িয়েছে বাংলাদেশের ভবিষ্যতও। এর চাইতে বড় ট্র্যাজেডি হয়তো শেকসপীয়ারও লিখতে পারতেন না, এর চাইতে জটিল কোনো গেম অব থ্রোন্সও হতে পারত না। এই লেখা শেষ হোক মেজর জলিলের লেখা একটি কবিতা দিয়ে।
আর দেবতা নয়, নয় শান্তির দূত
নহে কাব্য, নহে কবিতা। এসো বিদ্যুৎ,
এসো বিপ্লব, এসো ঝঞ্ঝা, এসো আগুন,
এসো সংগ্রামের সাথী রক্তঝরা ফাগুন।
সূত্রঃ
অধ্যায়-১
১। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা– লে. কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি
২। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর– কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.)
৩। জাসদের উত্থান-পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি– মহিউদ্দীন আহমদ
৪। বিএনপি সময়- অসময় – মহিউদ্দীন আহমদ
৫। যা ভেবেছি, যা বুঝেছি, যা করেছি– কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম
৬। ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন- মেজর জেনারেল আমিন আহম্মেদ চৌধুরী
৭। বঙ্গবন্ধুর হত্যামামলার রায়– আনু মুহাম্মদ/ জেনারেল শফিউল্লাহের সাক্ষ্য
অধ্যায়-২
১। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর– কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.)
২। জাসদের উত্থান-পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি– মহিউদ্দীন আহমদ
৩। বিএনপি সময়- অসময় – মহিউদ্দীন আহমদ
পর্ব-৩
১। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা– লে. কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি
২। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর– কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.)
৩। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন চৌধুরী
৪। লে. কর্নেল ফারুক ও মেজর রশিদের সাক্ষাৎকার, স্যাটারডে পোস্ট/ ১৫ আগস্ট, ১৯৮৩ এবং ৭ নভেম্বর, ১৯৮৩
৫। হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফারের সাক্ষাৎকার, দৈনিক প্রথম আলো
পর্ব-৪
১। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা– লে. কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি
২। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর– কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.)
৩। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন চৌধুরী
৪। দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা– মেজর জেনারেল জাফর ইমাম
৫। ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন– মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী
৬। বিএনপি সময়- অসময় – মহিউদ্দীন আহমদ
৭। জাসদের উত্থান-পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি– মহিউদ্দীন আহমদ
৮। বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-১৯৮১ – ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন
৯। হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফারের সাক্ষাৎকার, দৈনিক প্রথম আলো
পর্ব-৫
১। জাসদের উত্থান-পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি– মহিউদ্দীন আহমদ
২। বিএনপি সময়- অসময় – মহিউদ্দীন আহমদ
৩। অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা– মেজর (অব.) এম এ জলিল
৪। যা দেখেছি, যা বুঝেছি, যা করেছি– কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম
৫। Bangladesh: The Unfinished Revolution- Lawrence Lifschultz
৬। ফাঁসির মঞ্চে কর্নেল তাহের– আনোয়ার কবির
৭। বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-১৯৮১ – ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন
৮। এ লিগ্যাসি অব ব্লাড- অ্যান্থনি মাসকারেনহার্স
৯। Memoirs of Gul Hasan Khan– General Gul Hasan Khan
১০। হাসানুল হক ইনুর সাক্ষাৎকার – দৈনিক আমাদের সময়/ ৬ নভেম্বর, ২০১০।
১১।ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের সাক্ষাৎকার– দৈনিক আজকের কাগজ/ ১৫ জানুয়ারি, ১৯৯২।
১২।কর্নেল তাহেরের জবানবন্দী– সামরিক আদালত, ১৯৭৬
পর্ব-৬
১। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা– লে. কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি
২। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর– কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.)
৩। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন চৌধুরী
৪। দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা– মেজর জেনারেল জাফর ইমাম
৫। Bangladesh: The Unfinished Revolution- Lawrence Lifschultz
৬। ফাঁসির মঞ্চে কর্নেল তাহের– আনোয়ার কবির।
৭। বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-১৯৮১ – ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন
৮। ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন– মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী
৯। হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফারের সাক্ষাৎকার, দৈনিক প্রথম আলো
১০। মীর শওকত আলীর সাক্ষাৎকার– দৈনিক আমাদের সময়, ৪ নভেম্বর, ২০১০।
পর্ব-৭
১। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা– লে. কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি
২। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর– কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.)
৩। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন চৌধুরী
৪। দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা– মেজর জেনারেল জাফর ইমাম
৫। Bangladesh: The Unfinished Revolution- Lawrence Lifschultz
৬। সৈনিক জীবনঃ গৌরবের একাত্তর,রক্তাক্ত পঁচাত্তর – মেজর জেনারেল হাফিজ উদ্দিন আহমদ
৭। ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন– মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী
৮। এ লিগ্যাসি অব ব্লাড- অ্যান্থনি মাসকারেনহার্স
৯। বাংলাদেশে সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সঙ্কট– মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি
১০। গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী- মেজর নাসির উদ্দীন
১১। হুদা ও আমার যুদ্ধ- নীলুফার হুদা
১২। যা ভেবেছি, যা বুঝেছি, যা করেছি– কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম
১৩। বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-১৯৮১ – ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন
পর্ব-৮
১। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা– লে. কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি
২। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন চৌধুরী
৩। দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা– মেজর জেনারেল জাফর ইমাম
৪। ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন– মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী
৫। বিএনপি সময়- অসময় – মহিউদ্দীন আহমদ
৬। জাসদের উত্থান-পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি– মহিউদ্দীন আহমদ
৭। বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-১৯৮১ – ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন
৮। Bangladesh: The Unfinished Revolution- Lawrence Lifschultz
৯। ফাঁসির মঞ্চে কর্নেল তাহের– আনোয়ার কবির।
১০। এ লিগ্যাসি অব ব্লাড- অ্যান্থনি মাসকারেনহার্স
১১। হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফারের সাক্ষাৎকার, দৈনিক প্রথম আলো
১২। আবু ওসমান চৌধুরীর সাক্ষাৎকার– দৈনিক প্রথম আলো/ ৭ নভেম্বর, ২০১০।
১৩। মীর শওকত আলীর সাক্ষাৎকার– দৈনিক আমাদের সময়, ৪ নভেম্বর, ২০১০।
১৪। হাসানুল হক ইনুর সাক্ষাৎকার – দৈনিক আমাদের সময়/ ৬ নভেম্বর, ২০১০।
পর্ব-৯
১। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা– লে. কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি
২। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর– কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.)
৩। জাসদের উত্থান-পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি– মহিউদ্দীন আহমদ
৪। বিএনপি সময়- অসময় – মহিউদ্দীন আহমদ
৫। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন চৌধুরী
৬। বাংলাদেশে সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সঙ্কট– মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি
৭। গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী- মেজর নাসির উদ্দীন
৮। দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা– মেজর জেনারেল জাফর ইমাম
৯। Bangladesh: The Unfinished Revolution- Lawrence Lifschultz
১০। ফাঁসির মঞ্চে কর্নেল তাহের– আনোয়ার কবির
১১। বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-১৯৮১ – ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন
১২। সৈনিক জীবনঃ গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর – মেজর জেনারেল হাফিজ উদ্দিন আহমদ
১৩। ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন– মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী
১৪। এ লিগ্যাসি অব ব্লাড- অ্যান্থনি মাসকারেনহার্স
১৫। হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফারের সাক্ষাৎকার, দৈনিক প্রথম আলো
১৬। বেগম লুৎফা তাহেরের সাক্ষাৎকার– দৈনিক ইত্তেফাক/ ২৭ আগস্ট, ২০১০
১৭। আবু ওসমান চৌধুরীর সাক্ষাৎকার– দৈনিক প্রথম আলো/ ৭ নভেম্বর, ২০১০।
১৮। মীর শওকত আলীর সাক্ষাৎকার– দৈনিক আমাদের সময়, ৪ নভেম্বর, ২০১০।
১৯। হাসানুল হক ইনুর সাক্ষাৎকার – দৈনিক আমাদের সময়/ ৬ নভেম্বর, ২০১০।
২০। Military Coup in Bangladesh and the CIA Link – Khasru/The US National Archives, Documents 1975 Dacca, Telegram from the Embassy in Bangladesh to the Department of States
পর্ব-১০
১। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা– লে. কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি
২। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর– কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.)
৩। জাসদের উত্থান-পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি– মহিউদ্দীন আহমদ
৪। বিএনপি সময়- অসময় – মহিউদ্দীন আহমদ
৫। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন চৌধুরী
৬। বাংলাদেশে সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সঙ্কট– মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি
৭। গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী- মেজর নাসির উদ্দীন
৮। বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-১৯৮১ – ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন
৯। এ লিগ্যাসি অব ব্লাড- অ্যান্থনি মাসকারেনহার্স
১০। হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফারের সাক্ষাৎকার, দৈনিক প্রথম আলো
১১। আবু ওসমান চৌধুরীর সাক্ষাৎকার– দৈনিক প্রথম আলো/ ৭ নভেম্বর, ২০১০।
১২। মীর শওকত আলীর সাক্ষাৎকার– দৈনিক আমাদের সময়, ৪ নভেম্বর, ২০১০।
১৩। হাসানুল হক ইনুর সাক্ষাৎকার – দৈনিক আমাদের সময়/ ৬ নভেম্বর, ২০১০।
পর্ব- ১১
১। জাসদের উত্থান-পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি– মহিউদ্দীন আহমদ
২। বিএনপি সময়-অসময় – মহিউদ্দীন আহমদ
৩। ফাঁসির মঞ্চে কর্নেল তাহের– আনোয়ার কবির
৪। Bangladesh: The Unfinished Revolution- Lawrence Lifschultz
৫। বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-১৯৮১ – ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন
৬। মুজিববাহিনী থেকে গণবাহিনী- ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ
৭। মৃত্যুদণ্ড দেশে দেশে যুগে যুগে– শফিক রেহমান
৮। বাংলাদেশে সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সঙ্কট– মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি
৯। বাংলাদেশঃ এ লিগেসি অব ব্লাড– অ্যান্থনি মাসকারেনহার্স্
১০। CIA Role in 1975 Bangladesh Coup– Lawrence Lifschultz
১১। বেগম লুৎফা তাহেরের সাক্ষাৎকার– দৈনিক ইত্তেফাক/ ২৭ আগস্ট, ২০১০
১২। মীর শওকত আলীর সাক্ষাৎকার– দৈনিক আমাদের সময়/ ৪ নভেম্বর, ২০১০।
১৩। আবু রুশদের কলাম– দৈনিক নয়া দিগন্ত/ ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭।
১৪। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ– জেনারেল আমীন আহম্মদ চৌধুরীর কলাম/ ১৫ আগস্ট।
১৫। Lawrence Lifschultz’s four part columns– The Daily Star/ 15, 16, 17 & 20 August 2005


Comments
Post a Comment