পারগেটরি

 


এক

ধরুন,আপনি বসে আছেন কোনো এক পছন্দের রেস্তোরাঁয়,আজকে এক দারুণ অফার চলছে।কাজের ফাঁকে সময়ই হয় না আপনার বাইরে কোথাও যাবার,হ্যাং আউটেও যান না তেমন ।অর্ডার দিয়েছেন,এই ফাকে স্মোকিং জোন থেকে ঘুরে এসেছেন। আরাম করে পায়ের ওপর পা তুলে ডানহিল মাস্টারব্লেন্ড সিগারেট টানার সুখানুভূতি এখনো তাজা আপনার মনে।সহসা যদি আপনার সাবেক প্রেমিকা তার বর্তমান প্রেমিকের সাথে লুতুপুতু করতে করতে আপনার দৃষ্টিসীমায় এসে বসে- অমন অবস্থায় কেমন লাগবে আপনার?  

খুব মেজাজ খারাপ হবে না? শানের মেজাজও অমন খাট্টা হয়ে গেল রুহিকে দেখে।ওর সাবেক প্রেমিকা রুহি এখন চুটিয়ে প্রেম করছে।খলবল করে হাসছে,যে হাসি দেখার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষায় ছিল শান।তবে ও হাসি এখন আরেকজনের জন্য।এমন একটা অবস্থায় কি রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে যাবার কথা না শানের? ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বেরিয়ে যেতে।কিন্তু গেল না একটা কারণে- এটা পে ফার্স্ট রেস্তোরাঁ, কাজেই এখন বেরিয়ে গেলে টাকা কটা জলে যাবে।

আচ্ছা,ওদের বলি পার্সেল করে দিতে আমার অর্ডারটা! এরপর অন্য কোথাও গিয়ে নাহয় খাব!

ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া, কিন্তু শানের কেন যেন মনে ধরল না এটা। নিজেকে কেন যেন এক মহাপুরুষ হবার ট্রেনিং দিতে মনে চাইল ওর।মনেপ্রাণে ভালোবাসা নারী অপরের কণ্ঠলগ্ন হয়ে আছে- এমন দৃশ্য যে সহ্য করতে পারে,সে মহাপুরুষ নয়তো কী? কোনো এক অজানা কারণে দূরে বসে রুহির প্রেম দেখতে লাগল শান,আর বুকের ভেতরের জ্বালা বাড়াতে লাগল।

উহ! কী অসহ্য! বেহায়াটা ওর চুলে হাত বোলাচ্ছে! উফফফফ! আমি কখনো ওর হাতটাও ধরিনি কখনো, আর অসভ্যটা! আহ!

শানের প্রবল ইচ্ছে হল উঠে গিয়ে রুহির নতুন প্রেমিকের টুটি চেপে ধরতে।কিন্তু সে নিপাট ভদ্দরনোক, তাই নিজের ভদ্দরতা বজায় রাখতে হল ওর।একটা রিভলবার যদি পেত শান! এক গুলিতে শালাকে খুন করত,অন্য গুলিতে নিজের খুলি উড়াত সে।কিন্তু,ওর কাছে তো এখন রিভলবার নেই।কাজেই শালাকে হজম করা ছাড়া উপায় নেই ওর আর কোনো।

“এক্সকিউজ মি, এখানে কেউ আছে?”

চট করে বাস্তবে ফিরে এলো শান।সে সামনে তাকাল,দেখল এক ছিপছিপে তন্বী দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে।

আরে,আমার সাথে বসবে কেন মেয়েটা? জায়গা নেই আর?

শান আশপাশে তাকিয়ে দেখল,অফারের টানে আরো মানুষ এসেছে এখানে,আর তাতেই ওর মত অফারলোভীতে ভরে গেছে রেস্তোরাঁ।

“বসুন,”শান মাথা নেড়ে ইশারা করল মেয়েটাকে,”আমি সিঙ্গেল।”

মেয়েটা হাসতে লাগল,শান একটু বিব্রত হল ওর শব্দচয়নে।ওর সামনের চেয়ারে বসে মেয়েটা একগোছা নীল চুল কপালের ওপর থেকে সরাতে সরাতে বলল, “আপনি যে সিঙ্গেল তা আপনার চেহারাই বলে দিচ্ছে মিস্টার।”

শান বোকার মত হাসল একটু, “স্যরি, আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম যে আমি একাই আছি।মাফ করবেন।”

এরপরই একটু থেমে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,”কেন বলুন তো? সিঙ্গেল মানুষের চেহারায় কি লেখা থাকে তারা সিঙ্গেল?”

মেয়েটা একটু হাসল, “না,আপনি আসলেই ক্ল্যাসিক দেবদাস লুক নিয়ে বসেছিলেন। আশপাশে থেকে যে বলতে পারবে যে আপনি সদ্য ছ্যাঁকা খেয়েছেন।”

শান অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল,সে কি আসলেই এমন বিরহী ভাব নিয়ে বসেছিল? তাহলে তো মস্ত লজ্জার ব্যাপার হবে।সে একজন সফল মানুষ,অন্তত সমাজ তাই জানে।এমন বিরহী ভাব নিয়ে বসে থাকবে টিনেজাররা- ওর মত টগবগে ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তি কেন এভাবে থাকবে? পুরুষোচিত হচ্ছে না বিষয়টি।

“তারপর বলুন, আপনার এমন বিরহী ভাবের কারণ কী? রিসেন্ট ব্রেক আপ হয়েছে?” থুতনির নিচে হাত রেখে আয়েস করে প্রশ্নটা করল মেয়েটা, যেন সে বেশ মজা পাচ্ছে শানকে দেখে।

“জ্বি না,” শান হাসল একটু, “ব্রেক আপ হয়েছে আরো বহু বছর আগে।”

চোখ বড় বড় হয়ে গেল মেয়েটির, “তাই নাকি?”

শান মুচকি হাসল, “জ্বি।”

“তাহলে এখনো আপনি এমন অভাগা লুক নিয়ে বসে আছেন কেন? আপনাকে দেখে দেবদাস চরিত্রে কাস্ট করানো যাবে,জানেন আপনি?” মেয়েটা ওর দিকে ঝুঁকে এসে জিজ্ঞেস করল, “নাকি এটা নতুনভাবে কাউকে ধরার টোপ?”

শান হো হো করে দিলখোলা হাসিতে ফেটে পড়ল,কথাটা তো দারুণ বলেছে মেয়েটা!

“কি? হাসছেন যে বড়?” মেয়েটা জিজ্ঞেস করল,”আমার কথা বিশ্বাস হল না?”

মেয়েটার কালো চোখ সরু হয়ে এসেছে, শান সেটা বেশ উপভোগ করল। মেয়েটা আত্মবিশ্বাসী- সব সুন্দরী মেয়েরাই আত্মবিশ্বাসী হয়। কিন্তু সেজন্য না, মেয়েটা জানে সে কী করছে। ভাবালুতা নেই ওর মধ্যে, কেমন একটা ধার আছে। এরা সঙ্গী হিসেবে দারুণ- বাহুল্য ন্যাকামো থাকে না এদের।

“বিশ্বাস না করার কি আছে? আপনারা যে একটু সিম্প্যাথেটিক ছেলেদের পছন্দ করেন।এমন ছেলে পছন্দ করেন যাদের একটু কেয়ার দেখিয়ে চুক চুক করে বলবেন- আহা! কত্ত কষ্ট তোমার,ইশ! কিন্তু ভুলেও এদের সাথে ঝুলে পড়বেন না; কারণ এরা ঠিক প্রেমিক টাইপ না, অতি রোমান্টিসিজমের পাল্লায় পড়ে এরা লেজেগোবরে করে ফেলে পুরো বিষয়টাই। ঠিক বলেছি তো?”

“নারী চরিত্র নিয়ে আপনার দেখি অগাধ পাণ্ডিত্য!” আলগোছে একটা ভেংচি কাটল মেয়েটা যেন শানকে, “তা কতদিনের এক্সপেরিয়েন্স এ লাইনে?”

“প্রফেশনাল সিডিউসিং? আজকে পয়দা হলো আমার।”

“আর ফিমেল সাইকোলজি অ্যানালিসিস?”

“ওই জিনিস স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানেন না, আমি তো ফানাফিল্লাহ থেকে শত আলোকবর্ষ দূরে!”

দুজনই হি হি করে হাসতে থাকল। তাদের হাসিতে ছেদ বসালো স্পিকারে অর্ডারের অ্যানাউন্সমেন্ট- অর্ডার নাম্বার ৪২! অর্ডার নাম্বার ৫৬!

টোকেন দেখল মেয়েটা, “আমারটাও হয়ে গেছে দেখছি।”

“টেবিলে আসার আগে অর্ডার দিয়ে এসেছিলেন নাকি?” শান শুধায়, কারণ মেয়েটাকে অর্ডার দিতে দেখেনি সে।

মেয়েটা আবার হাসল, “হ্যাঁ, আমার জানাই ছিল কী খাব আমি। তাই আর দেরি করিনি।”

“কী অর্ডার করলেন?” প্রশ্নটা করেই কল্পনায় নিজের কপালটা ঠুকে দিল সে দেয়ালের নিয়ন-লাইট ডোকেরেশন প্যানেলের মধ্যে- আহাম্মক কাঁহিকা!

মেয়েটা অর্থপূর্ণভাবে ভুরু নাচাল, “একটু পরই দেখতে পাবেন।”

শান বিস্মিত হল মেয়েটার প্রম্পট,বুদ্ধিমান উত্তরে।

ওকে, আই অ্যাম ইম্প্রেসড!

অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়ানো বার্গার খুলতেই একটা মোহনীয় সুবাস এলো শানের নাকে।সে পাশের প্লেটে দেওয়া নাগামরিচের পেস্ট দেয়া চিকেন ড্রামস্টিকের এক অংশ খুলে মুখে পুরল।রসালো একটা অনুভূতি হলো ওর মুখে,সাথে সাথেই পেল ঝালের প্রথম ধাক্কা। ভোঁতা একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল ওর জিভ,তালু আর গালের মাংসে।

“আপনি ঝাল খেতে পারেন না?” আবারও ভুরু নাচাল মেয়েটা। শান বুঝল ওর মুখ লাল হয়ে গেছে।

“না, একদমই না,” আরেকবার মুখে দিয়ে শান বলল,” এ জিনিসের সাথে আমার জন্মান্তরের শত্তুরতা!”

“তবে নিলেন যে? জানতেন না এটা কী?”

“জানতাম,” শান বার্গারের দিকে মনোযোগ দিতে দিতে বলল, “তবে এটা বেশ লাগে আমার।এখানে এলেই এটা নিই।একটু সবুর করুন দেখবেন আমি ঝালের চোটে লাফাচ্ছি!”

“ইন্টারেস্টিং,” মেয়েটা নিজের বার্গার খুলতে খুলতে মন্তব্য ছুঁড়ে দিল, “আপনি মাজোকিস্ট নাকি?”

শানের ঝকঝকে দাঁতের সারি দেখা গেল, “আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি, তাই তোমার কাছে ছুটে আসি।”

মেয়েটা নিজেও এলআরবি ফ্যান, তাই মিলিয়ে নিতে পারল সে অনায়াসেই।

“আমি ছেলেবেলাটা খুব সুন্দর কেটেছে এসব গানের সাথে, ভালোই ছিল সময়টা।”

“নাইন্টিজ কিড?”

“লেট এইটিজ,” শান মুচকি হাসল, “ফেব্রুয়ারি ১৬, ১৯৮৭।”

“২৮ আগস্ট, ১৯৯২,” মেয়েটা কোকের গ্লাসে ছোট্ট করে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি পাক্কা নাইন্টিজ কিড।”

ভুরুতে একটা ছোট্ট ঢেউ উঠল শানের- কে যেন বলেছে মেয়েদের বয়স জানতে চেয়ো না? মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি এলো যে!

“ইন্টারেস্টিং তো,” শান একগাল হেসে বার্গারে এক মোক্ষম কামড় বসিয়ে চুপ মেরে গেল। মেয়েটা ওর কথা শোনার জন্য কয়েকসেকেন্ড চুপ করে রইল, কিন্তু শানের মুখে কোনো কথা নেই। মুখে খাবার পুরে বসে আছে সে।

“কী ব্যাপার? কথা বলছেন না যে?”

“খাওয়াটা অনেকটা রিচুয়ালের মত আমার কাছে,” শান সাপের মত কপাত করে গিলে ফেলল মুখের খাবার, “প্রথম কামড়ে আমি ধীরে সুস্থে স্বাদ আস্বাদন করি, এরপর সাধারণভাবে খাই। ফার্স্ট ইমপ্রেশন ইজ ইম্পর্ট্যান্ট, বি ইট পার্সন অর ফুড।”

মেয়েটা মুচকি হাসল,হাসিতে ওর টানা টানা চোখজোড়া ছোট হয়ে গেল। শানের বেশ ভালো লাগল মেয়েটার হাসি। একটা অব্যক্ত ভাষা আছে যেন ওর হাসিতে।

“এখন আমি আমার ফার্স্ট ইম্প্রেশন জানতে ইন্টারেস্টেড হয়ে গেলাম,” মেয়েটা আবারো তার কালো চোখজোড়ার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিদ্ধ করল শানকে।

“ডেভিলিশ অ্যাঞ্জেল।”

“অ্যান্ড ইউ আর টু চিজি।”

“ল্যাক্টোজ ইন্টলারেন্স আছে?”

“আর ইউ অ্যাফ্রেইড অব ডার্কনেস?”

“তার মানে উত্তরটা না,” মুচকি হেসে চোখ সরিয়ে নিল শান। সাইডব্যাগ থেকে এক ক্যান বিয়ার বের করে আয়েশ করে এক চুমুক দিল তাতে।

“গ্লেনফিডিখ? আপনার টেস্ট ভালো, মিস্টার শান।”

“আহ! ধন্যবাদ!”

“আপনি কিন্তু বেশ কথা জানেন,” মেয়েটা বার্গার কামড়ে বলল, “আপনি কবিতা লেখেন নাকি?”

শান ড্রামস্টিকে দাঁত বসিয়ে মাথা দোলাল, “লেখিনা বললে মিথ্যে বলা হবে। আর যে ছাইপাশ লিখি, তাকে কাব্য বলতেও আমার ঘোরতর আপত্তি আছে।”

শানের দিকে কয়েকমুহূর্ত স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেয়েটি, এরপর বলল, “আপনি মানুষটা বড় অদ্ভুত, একদম কবিতার মত।”

তুলনায় যারপরনাই চমৎকৃত হল শান।

আমি কবিতার মত! ভালো বলেছ মেয়ে!

কিছুক্ষণ চুপচাপ খেল দুজন।সহসা রুহির কাঁচভাঙা হাসি কানে এলো শানের,একমুহূর্তের জন্য ওর মুখে কালো ছায়া পড়ল।একনজরে সে রুহিকে দেখল,প্রেমিকের সাথে জমিয়ে প্রেম করছে-ওদের প্রেম জমে ক্ষীর হয়ে গেছে এই কদিনে।

“আপনার এক্স-গার্লফ্রেন্ড কি ওপাশের টেবিলের হলুদ-লাল ফতুয়া পরা ফর্সা মেয়েটি?”

মেয়েটার এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় শান,ওর মুখে কথা যোগায় না।

“কেন?”

“আপনি আড়চোখে বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছিলেন সেই শুরু থেকেই। আর যখনি একটু হাসির আওয়াজ আসছিল, অমনি আপনার মুখে বিষাদের ছায়া পড়ছিল।আমি কি ভুল বলেছি?”

মেয়েটার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে শানের কারবার! শানের মুখে কয়েকসেকেন্ড কথা যোগাল না।

“আপনি কীভাবে দেখলেন?” শান জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো রুহির দিকে পিঠ দিয়ে আছেন।”

“ওহ, ওর নাম তাহলে রুহি?” মেয়েটা ভুরু নাচিয়ে পাউট করল, “সুন্দর নাম তো!”

প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল সে, শান আর আগাল না ওদিকে।

“আপনি কি কেবলি কবি, না আরও কিছু করেন?”মেয়েটা কতক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল,”আপনার অ্যাটায়ার বা অ্যাটিচিউট কোনোটাই কবির মত নয়।“

“আমি একজন এন্ট্রেপ্রনার,” শান আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিল, “আপনি?”

“আমি একটা রিসার্চ ইনস্টিটিউটে আছি, “মেয়েটা মুচকি হেসে উত্তর দিল আবার।

“কুল! কী নিয়ে রিসার্চ করেন আপনারা, মিস. রিসার্চার? “

“অনেককিছু নিয়েই করি,” আবারও বাউলি কেটে বেরিয়ে গেল মেয়েটি।

“রিসেন্ট কী নিয়ে কাজ করেছেন, জানতে পারি?” শান হাল ছাড়ার পাত্র না।

“ব্যাংকিং সেক্টরে বিদেশি ব্যাংকের ইম্প্যাক্ট নিয়ে ছিল আমাদের লাস্ট প্রজেক্ট,” শানের কথার লাইন ধরে ফেলল মেয়েটি।

“নাইস…”

খাওয়া শেষে বিদায়ের পালা। শান হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল,”আমাদের পরিচয়পর্ব বাকি আছে বোধহয়, তাই না?”

মেয়েটা চোখ সরু করে তাকাল ওর দিকে,” সেরে ফেলুন তাহলে। দেরি করছেন কেন?”

“আমি শান মাকসুদ,” শান পকেট থেকে কার্ড বের করে দিল ওকে।

“আমি বিভা,” মেয়েটি হেসে ওর কার্ড গ্রহণ করল।

“এই? আগেপিছে নেই কিছু আর?”

মেয়েটার বাম গালে হালকা ভাঁজ পড়ল,বাঁকা হাসি হাসল সে। শান মাকসুদের সাথে খেলতে চাইল মেয়েটা।

“কেন? আগেপিছে কী আছে জেনে কী করবেন,মি. মাকসুদ?”

“জাস্ট কিউরিওসিটি,” শান হেসে জবাব দিল।

“কিউরিওসিটি কিলড দ্য ক্যাট, মি.মাকসুদ।”

“আ ক্যাট হ্যাজ নাইন লাইভস,” শান ভুরু নাচিয়ে উত্তর দিল, “ইনাফ টু ওয়েস্ট ফর কিউরিওসিটি, মিস বিভা।”

একটা মোহনীয় হাসি হেসে উঠে গেল বিভা। শান ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

মেয়েটা রহস্যময়ী,একটু বেশিই রহস্যময়ী।

কে জানে!

দুই

পরদিন সকালে বিভা ঘুম থেকে উঠে রোজকার নিয়মে ফেসবুকে ঢুঁ মারল। রাতে কেউ কোনো মেসেজ দিয়েছে কিনা চেক করতে হবে । ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে একটা,আইডির প্রোফাইল পিকচার দেখে ছোটখাটো শক খেল বিভা- শান মাকসুদ?

এ লোক আমাকে পেল কোত্থেকে?

শানের প্রোফাইল ঘেটে দেখল সে,লোকটা তেমন অ্যাক্টিভ না ভার্চুয়াল জগতে।থাকার মধ্যে আছে ক’টা কবিতা আর কিছু খবরের লিঙ্ক। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, লোকটা ফেসবুক সেলিব্রিটি গোছের কেউ না। তবে ওর ফ্রেন্ডলিস্ট দেখে একটু অবাক হল- হাজারখানেক ফ্রেন্ড আছে ওর।

আজব,কবিতা লেখার সুবাদে এত্ত ফ্রেন্ড আছে ওর? না ব্যবসার কন্টাক্ট এরা সব?

সাতপাঁচ ভেবে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করল বিভা।এরপর অফিসের জন্য তৈরি হতে গেল সে।

দুপুরে লাঞ্চব্রেকের সময় খিচুড়ি খেতে খেতে ফেসবুকের টাইমলাইন ঘাটছিল বিভা।এমন সময় সে দেখে,শান অনলাইন।

আজব,ওকে অনলাইন দেখাচ্ছে যে বড়?আজই না আমরা ফ্রেন্ড হলাম? পুরোই আজব!

একটা নক দেব? দেয়া যায় কিন্তু, লোকটা আমাকে খুঁজে পেল কী করে,জানা দরকার

নাহ! আমি মেয়ে,আহামরি সুন্দরী না হলেও, সুন্দরী ছেলেরা আমাকে নক দেবে,নয়তো আমি খেলো হয়ে যাব যে!

নক দেয়া আর ওর হয় না।

সে মনে মনে আশা করেছিল,শান আজ ওকে নক দেবে।কিন্তু ওই আশায় গুড়েবালি,শান নক দেয় না।বিভা ভাবতে থাকে,লোকটা চাচ্ছে কী? সে কি খেলতে চাচ্ছে ওর সাথে? দিন দুই পর সে নিসন্দেহ হল,শান ওকে নক দিবে না।

খেলতে চাইছ তুমি! আচ্ছা,সে দেখা যাবেআমিও খেলতে পারি

সেদিন বিকেলে অফিসের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিল বিভা,আজ বড্ড ঝক্কি গেছে।রিসার্চ পেপার জমা দেয়ার ডেট ছিল আজ- ওটা জমা দিয়ে সব কাজ গোছাতে গোছাতে চারটে বেজে গেছে।

ফোনের স্ক্রিনে চোখ পড়ল ওর,দেখে নোটিফিকেশন এসেছে ফেসবুকে।

শান মেসেজড ইউ….

কী! এখন মেসেজ দিয়েছে লোকটা! মানে কী?

বিভা ফোন হাতে নিয়ে দেখল মেসেজটা।

 হাই! ফ্রি আছেন আজ সন্ধ্যায়? একসাথে ডিনার করবেন? মাই ট্রিট!!!

আপনাকে দেখতে মন চাচ্ছে,আসুন না! আপনি রাজি থাকলে আমি ওয়েস্ট এন্ডে থাকব আটটার সময়। অ্যাশ ব্লেজার, নীল ডেনিম।

বিভার চোখ কপালে উঠল-লোকটা বলে কী! একলাফে কথা নেই,বার্তা নেই,সোজা ডেটের প্রস্তাব? মাথা খারাপ হয়েছে লোকটার?

তবে রিপ্লাই পাঠাতে দেরি করল না মেয়েটা- আসুন

অফিস থেকে বেরিয়ে নিজের লাল-কালো কাওয়াসাকি বাইকটায় চড়ল বিভা। রেস্তোরাঁটা খুব একটা দূরে না, যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না ওর।

ব্ল্যাক লেদার জ্যাকেট পরা বিভাকে দেখে শান বুঝতে পারল, ওর বিপি বেড়ে গেছে। পেটের ভেতর কিছু একটা গুলিয়ে উঠল ওর, অনুভূতিটা দারুণ উপভোগ্য ওর কাছে।

“আপনি কীভাবে এতটা সাহস করলেন, বুঝতে সমস্যা হচ্ছে আমার, মি. মাকসুদ।”

“একটা জুয়ো খেললাম, আর জিতেও গেলাম। আমার জীবনটা একটা ছোটখাট জুয়োর মত। আমি অত চিন্তা করি না। আজকে একটা স্পেশাল দিন আর আমি ভাবলাম আপনার সাথে ডিনার কাটালে নেহাত মন্দ হবে না। এখানে আর কিছুই নেই,” শান একগাল হেসে ওর প্লেট থেকে ফ্রেঞ্চফ্রাই তুলে নিয়ে সসে ডুবাল, এরপর আরামসে মুখে পুরে চোখ বুজে রইল কিছুক্ষণ।  

“তবে আপনার সাহস দেখে আমি ইম্প্রেসড, মি. মাকসুদ,” বিভা একগাল হেসে কোকে চুমুক দিল,”আই থট ইউ হ্যাভ ফরগটেন মি।”

“ফরগেট ইউ?” শান চোখ খুলল, ওর চোখে একরাশ বিস্ময়, “এমুহূর্তে আপনাকে ভুলে যাওয়া হল নেক্সট টু ইম্পসিবল, মিস. রুবাইয়াত বিভা।”

“আমি জিজ্ঞেস করব না আপনি আমার নাম জানলেন কী করে,” বিভা ভুরু নাচিয়ে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল শানের দিকে, “কারণ আপনি আমার ফেসবুক আইডি বের কর‍তে পেরেছেন, আপনার হাত বেশ লম্বা, বুঝতে পারছি। এখন চিন্তা হচ্ছে, একজন এন্ট্রেপ্রনার হিসেবে আপনার হাতটা কি বেশিই লম্বা নাকি আবার!”

শান হাসতে শুরু করল ওর হাসিতে দেবদূতের ছায়া দেখতে পেল বিভা।এখন বুঝতে পারল,লোকটা আসলে প্রাণশক্তির আধার।আর ওর হাসিতেই উপচে পড়ছে ওর অমিত প্রাণশক্তি।

হি ইজ কাইন্ড অব কিউট….- ভাবল বিভা।

“আমি কীভাবে আপনাকে বের করেছি, জানতে ইচ্ছে করছে, মিস বিভা?”

“যদি আপনার বলতে আপত্তি না থাকে কোনো,” বিভা মুচকি হেসে উত্তর দিল।

“আপনি বলেছিলেন আপনি এক রিসার্চ ফার্মে আছেন, রিসেন্টলি আপনারা ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা নিয়ে কাজ করেছেন। আমি টুকটাক এসব খবর রাখি, তাই আমি চট করে বুঝে যাই কোথায় খুঁজতে হবে আমাকে। আমি কটা কল করি, এরপর আমার লিস্ট ছোট হয়ে আসে। আমার লিস্টে তখন থাকে মাত্র তিনটা ফার্ম। এদের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারি আমি, দেখি কোনটার রিসার্চারদের গ্রুপফটোতে আপনি আছেন। এরপর আপনাকে পেয়ে যাই।এবার নামের মামলা। আমি আপনাদের এক সিনিয়র রিসার্চার- শোয়েব ভাইকে একটা নক দেই। উনি আবার আমার স্কুলের সিনিয়র- সম্পর্কটা তাই বেশ দারুণ; একদম মাখনের মত! বলি,এই মেয়েটার নামটা যেন কী! ভাই ঝপাঝপ বলে দেন,আমিও আপনাকে পেয়ে যাই! ব্যস! এরপরের কাহিনি তো জানেনই আপনি, ম্যাডাম।”

বিভা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় শানের দিকে,লোকটা তো আপাদমস্তক গোয়েন্দা! কীভাবে পারল সে এভাবে ওকে বের করতে?

“আপনি শোয়েব ভাইকে কী বলেছিলেন?”

“মেয়েটার সাথে এক রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল আমার, ওর কাছে আমার একটা জিনিস রয়ে গেছে।” ভুরু নাচাল শান।

“ফেরত চান নাকি সেটা, হুম?”

“আপনার জানলেন কীভাবে কী রয়ে গেছে আপনার কাছে?” খিক খিক করে হাসতে শুরু করল শান।

শানের দিকে তাকিয়ে থেকে হাততালি দিল বিভা,”আপনি পারেনও বটে! আপনি আসলেই বিজনেসম্যান, না ইন্টেলিজেন্স অফিসার?”

“আমি মাসুদ রানা,” শান হাসতে লাগল ওর কথায়, “মাসুদ রানা ফ্যান?”

“অনে-ক!” বিভার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল সহসা, “আপনি?”

“হ্যাঁ, আমিও এম আর নাইনের ফ্যান, “শান ওর স্টেকে কাটাচামচ বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রেবেকা, না সোহানা?”

“রেবেকা সাউল! ইশ…রানার সাথে বিয়েটা হয়েই যাচ্ছিল বেচারির! ”

 মাসুদ রানার প্রেমিকার জন্য দুঃখ গলে পড়ল যেন বিভার গাল বেয়ে,শানের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল বিভার ছলছলে চোখ দেখে।

রুহির কান্নাটাও এমন ছিল না!

“আমার মিত্রা সেন,”শান হেসে বলল,”শী ওয়াজ ড্যাম প্রিটি!”

“আপনার মনে হয় অমন ক্ল্যাসিক বাঙালি সুন্দরী পছন্দ? “

“বলা ভারি শক্ত, “শানের ঠোঁটের কোনায় এক ভারি মোহনীয় হাসি ফুটে উঠল, “মানুষের মন তো, কিছুই বলা যায় না হলফ করে।”

“আপনি পারেনও বটে, ব্যবসা ছেড়ে ফুলটাইম কাব্যচর্চা করুন। দেখবেন, ভালো করবেন। তা এবার বলুন, স্পেশাল দিনটা কী?”

“এখনই শুনবেন? ডিনার শেষে বলি, তাহলে সাসপেন্স থাকবে, নাকি?” বিভার দিকে তাকিয়ে হাসল শান, “এবার আপনার গল্প হোক,ম্যাডাম…”

“আমার গল্প আর কী,” বিভা একটু হেসে উত্তর দিল, “আমি জব করি, পাশাপাশি টুকটাক গান গাই। একটা গানের দল আছে আমার।”

“বাহ! নাম কী সেটার?”

“পিয়াসা।”

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল শান। হটাৎ এমন চুপ হয়ে যাওয়ায় একটু অপ্রস্তুত হলো বিভা।

“কিছু বলছেন না যে?” সে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, “এনিথিং রং?”

ওপারের ছোট্ট নদী, কাছে এসো,
তোমাতে অবগাহন করে মেটাই আমার আজন্ম পিয়াসা।
ওপারের গোলাপি আকাশ, ভালোবাসো,
তোমাতে উড়ে যাই আমি ছেড়েছুড়ে সব বিষাক্ত ব্যস্ততা।
ওপারের লাল সূর্য, একটু হাসো,
তোমাতে আমাতে জাগুক সায়াহ্নের এস্রাজের মূর্চ্ছনা।
ওপারের নির্জন পৃথিবী, দুঃখ নাশো,
তোমাতে আশ্রয় নিয়ে চোখ মুদব,এ আমার শেষ প্রার্থনা।

শানের কন্ঠে আবৃত্তি শুনে বিভার ঠোটজোড়া বাঁকা চাঁদের আকার নিল। লোকটা হঠাৎ কবিত্ব দেখানো শুরু করল যে!

“কার কবিতা?”

“আমার,” শান মুচকি হাসল, “মাত্র বানালাম।“

মুখে মুখে এমন কবিতা কেউ বানাতে পারে, জানত না বিভা। সে কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে বসে রইল শানের দিকে তাকিয়ে। লোকটা পারেও বটে!

“তা ম্যাডাম, আপনি কিন্তু দারুণ ভার্সেটাইল মানুষ,” শান বা হাতে ছুরিটা নিয়ে আনাড়ি কায়দায় স্টেক কাটতে কাটতে বলল, “রিসার্চারেরা গান গায়, জানতাম না।“

“ওটা আমার ভার্সিটির গানের দল,” বিভা কথার খেই ধরল, “ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারের গান শুরু, এখনো টুকটাক গান গাই। সবাই যার যার মত ব্যস্ত, কে-ই আর সময় দেবে বলুন।“

“আপনি ছিলেন কোথায়?”

“ঢাকা ইউনিভার্সিটি, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে, “বিভার চোখে এক ঝলক নস্টালজিয়া খেলে গেল, “আপনি?”

“আইইউটি, সিএসই-তে,” শান জানত বিভার পরের প্রশ্নটা কী হবে।

“আপনি ইঞ্জিনিয়ার? তবে এন্ট্রেপেনার হলেন যে?”

দুলে দুলে হাসতে লাগল শান, ওর হাসিতে আবারো অপ্রস্তুত হলো বিভা।

এই লোকটা এমন করে কেন?

“ভাবলাম, নতুন কিছু করি জীবনটা নিয়ে। অনেকটা সময় তো কাটল সার্কিট আর স্ক্রু-ড্রাইভার নিয়ে।“

“আইটি ফার্ম- টার্ম দিলেন না কেন?”

“ইচ্ছে করেনি, তাই দিই নি।”

“সে কী? বাসায় কিচ্ছু বলে নি?”

“বাসা থাকলে তো কেউ কিছু বলবে!” একটা রহস্যময় হাসি হেসে খাওয়ায় মনোযোগ দিল শান। বিভা বুঝল, গোলমাল আছে কিছু একটা। তবে এখন চাপাচাপি করল না সে, তরল আলাপে চলে গেল।

“আজকে আমার বার্থডে,” ডিনার শেষে ক্যাজুয়ালভাবে বলল শান, যেন সে ক্রিকেটের স্কোর বলছে। আকাশ থেকে পড়ল বিভা, “আপনি বার্থডে সেলিব্রেট করলেন আমার সাথে ডিনার করে? আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। এসবের মানে কী?”

“আগেই বলেছি, বাসায় কেউ নেই; কী করব আর বলুন! তাই ভাবলাম ডিনারটা আপনার সাথেই সারি আজকে। চিন্তা করবেন না, আপনার বার্থডের ডিনারও করব একসাথে – দেন উই আর ইভেন।”

বিভার বিস্ময় কাটতে কাটতে শান মুচকি হেসে বিদায় নিয়ে চলে গেছে।  রেস্তোরাঁয় অবাক হয়ে এগজিটের দিকে তাকিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বিভা।

লোকটা মানুষ না এলিয়েন?

বাসায় ফিরে ফেসবুকে ঢুকল সে, ফেসবুক বলছে, আজকে আসলেই শানের জন্মদিন। টাইমলাইন অফ করা, তাই শুভেচ্ছা জানায় নি কেউ তার ওয়ালে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল বিভা, লোকটার পাগলামো তাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলল।

ওকে চিনতে হবে আমার

এরপর থেকে দুজনের চ্যাটিং নিত্যকার বিষয় হয়ে দাঁড়াল।

শান মানুষটা দারুণ আমুদে। যথেষ্ট টাকাকড়ি আছে। ব্যবসায়িক বুদ্ধি ভালো, কাজেই কয়েকবছরে ভালোই সচ্ছল হয়েছে সে।  কারওয়ান বাজারে তার অফিস, বিভা দুয়েকবার গেল সেখানে। বিভাকে সবচেয়ে আকৃষ্ট করেছে শানের আচরণ। কেমন একটা নির্ভরতা আর নিরাপত্তা আছে ওর মধ্যে।

ওদিকে বিভার বাসায় বিয়ের আলাপ উঠেছে; আকার-ইঙ্গিতে সে বুঝতে পারছে। বয়স মাত্র সাতাশ, এখনই বিয়ে করাটা কি উচিত হবে ওর? অবশ্য বান্ধবীদের সার্কেলে একমাত্র বিভাই গাটছড়া বাধেনি। রাতে বিছানায় গেলে ইদানীং শানের কথা মাথায় আসে তার। লোকটার চারপাশে কেমন এক রহস্যময়তা,  সে রহস্যময়তা রহস্যময়তা তাকে টানে।  

সঙ্গী হিসেবে শান খারাপ হবে না।

তিন

কয়েকমাস চলে গেছে।

“বিভা, আজকে আমাকে সময় দিতে পারবে কিছুক্ষণ?”

বিভার বস শোয়েব রহমানের কথায় মাথা নাড়ল সে, “হ্যাঁ শোয়েব ভাই, বলুন।”

“চলো, কোথাও বসি। বেশিক্ষণ না, এই ধরো আধাঘন্টা সময় লাগবে।”

“সমস্যা নাই, চলুন।”

গুলশান-২ এ বিভার অফিস। ওদিকের একটা ক্যাফেতে তাকে নিয়ে গেল শোয়েব। কফি খেতে খেতে সে বলল, “দেখ বিভা, তুমি অ্যাডাল্ট। তোমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করার রাইট নাই আমার। তাও একটা পার্সোনাল প্রশ্ন করতে চাইছিলাম। শানের সাথে অ্যাফেয়ার আছে কি তোমার?”

শোয়েব কখনোই ব্যক্তিগত কথা বলেনা। তার মত প্রফেশনাল সম্পর্ক বজায় রাখা মানুষের মুখে এমন প্রশ্নে বড্ড অবাক হলো বিভা।

“কেন? কোনো সমস্যা আছে কি শানের?”

শানের মত মানুষ কম দেখেছে বিভা। কাজেই শোয়েবের কথায় শানকে নিয়ে তার মনোভাব পাল্টাবে, এমন না। তবু শোয়েবের কথা শোনাটা জরুরি।

“না, ঠিক সমস্যা না। ওর একটা টেন্ডেসি আছে। আমার সাথে ওর পরিচয় আজ বহুদিন। আমরা এক স্কুলের ছাত্র। ও আমার দুই ক্লাস জুনিয়র। তার মত ভালো মানুষ আমি কম দেখেছি। আমরা সবাই জানতাম, সে অনেক দূর যাবে।

একটা সময় একটা রিউমার কানে আসে আমার। তখন আমি ভার্সিটিতে পড়ি। আমার ভার্সিটিরই এক জুনিয়র মেয়ের সাথে নাকি তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল। ব্রেক আপের পর এখন শান নাকি অত্যন্ত ডিপ্রেসড।”

“মেয়েটার নাম রুহি?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শোয়েব, “হ্যাঁ, রুহি। শান আর রুহির সম্পর্ক হলোই বা কবে, আর ভাঙলই কবে- জানলাম না কেউই। ছোটদের ব্যাপার, আমি নাক গলাই নাই আর। এরপরের গল্পটা বেশ প্যাথেটিক।  শানের মা মারা যায়। বাবা আবার বিয়ে করে। তখন শান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে, আর ফেরেনি। রুহির বিষয়টা ততদিনে ক্যাম্পাসে চাউর। শান তো আইইউটিতে, ও জানেনা। রুহির নতুন প্রেম হয়। সেটা শুনে আরো ভেঙে পড়ে শান। পড়ালেখায় গ্যাপ পড়ে, সে ড্রপ আউট হয়ে যায় আইইউটি থেকে।“

আঁতকে উঠল বিভা, “মানে? শান পাস করেনি?”

“না, সে আর পড়াশোনা করে নি। সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়েছিল বোধ হয়। নানা মারা যাবার পর মায়ের ভাগে যা পড়েছিল জায়গা জমি, তা বেচে দিল সে। সবার সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করল। আল্লার ইচ্ছে, ভালো পয়সাকড়ি কামাতে পারল সে কয়েকবছরে।

এরপর আমরা আর জানতাম না কিছু।  হঠাৎ স্কুলের অ্যালাইমনাই সোসাইটিতে ওকে দেখলাম বছর চারেক আগে। ততদিনে সে বিরাট পসার জমিয়ে বসেছে। সে যে কেবল কলেজ পাশ, সেটা বিলকুল চেপে যায় সে। শানের লেখা দারুণ, বই-টই বের করেছে, সম্মাননা পেয়েছে। এলাহী কারবার। তখন একটা ফিসফিসানি শোনা গেল, শান নাকি বছর বছর বান্ধবী পাল্টায়।”

একটা ইলেক্ট্রিক শক খেয়ে সোজা হয়ে বসল বিভা- মানে?

“বছর বছর বান্ধবী পাল্টায় মানে?”

“না না, ওরকম না,” তাড়াতাড়ি হাত তুলে বিভাকে শান্ত করতে চেষ্টা করল শোয়েব, “সে খারাপ কিছু করেনা। সে সুন্দর করে ডেট করে, কয়েকমাস পর সম্পর্কটা থিতু হচ্ছে- এমন সময় হঠাৎ করে সে তার পাস্টের গল্প বলে মেয়েটাকে। এরপর কেন যেন কোন মেয়েই আর আগায় না। কেন যেন মেয়েরা এমন আনস্টেবল কাউকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চায় না। কিছুদিন চুপ করে থাকে শান, এরপর আবার খুজতে বেরোয় ভালোবাসা। এই এক অবিরাম সার্কেল- আজ প্রায় বছর আট হল সে এভাবেই ভালোবাসা খুঁজে বেড়াচ্ছে। তোমাকে চিনি, তাই আগেভাগেই বললাম আর কী। কিছু মনে করো না।” 

বিভা দম দেয়া পুতুলের মত বেরিয়ে এলো ক্যাফে থেকে। বাসায় ফিরে চুপচাপ নিজের ঘরে লাইট অফ করে শুয়ে রইল। পরদিন ছুটি নিল- অফিসে এলো না। কারো কল ধরল না, মেসেজের রিপ্লাই দিল না। শানেরও না।

শোয়েব পরদিন সকালে একটা মেসেজ পেল বিভার কাছ থেকে-

ভাই, রুহির ফোন নাম্বার ম্যানেজ করে দিতে পারবেন?

রুহির দিন শুরু হলো তার প্রেমিকের চুমুতে। দেশে ফিরেছে সে এক বছর হলো। ইংল্যান্ডের একটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছে সে, এখন এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সে। খুব শিগগিরই দ্বিতীয় বারের মত বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছে সে।

“রুহি হানি, তোমার ফোন!”

শুক্রবার সাতসকালে কে কল করল আবার?

রুহি কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল বিভার গলা।

“ড.আলিয়া জাহান রুহি বলছেন?”

“জ্বি, বলুন।”

“আমি রুবাইয়াত বিভা। আমার আপনার সাথে দেখা করা প্রয়োজন। ইটস আর্জেন্ট।”

রুহির কপালে ভাঁজ পড়ল, “কেন?”

“আমি শান মাকসুদের বিষয়ে কথা বলতে চাইছি। আশা করি আপনাকে গুলশানের ক্যাটস আই ক্যাফেতে সন্ধ্যা সাতটায় পাবো। এসে এই নাম্বারে কল করবেন প্লিজ।”

লাইন কেটে গেল। রুহি স্থাণু হয়ে দাড়িয়ে রইল। তার মুখে কথা যোগাল না।

আমার সব নষ্ট করেও কি শান্তি পাচ্ছে না শান? এতদিন পর আবার কী শুরু করেছে হারামিটা!

একবার সে ভাবল, যাবে না। কী দরকার যাবার! কিন্তু বিভা মেয়েটার কন্ঠে এমন কিছু ছিল, যা ওকে বাধ্য করছে যেতে। রুহির ভেতর থেকে কেউ বলছে, “যাও রুহি, যাও!”

শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটা।

রুহিকে দেখে বিভা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল।  তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ত্রিশ কি বত্রিশ বছরের এক নারী। মাঝারি গড়নের রুহির গোলগাল চেহারায় এক অপূর্ব সুষমা, কেমন এক অপার্থিব সৌন্দর্য ঘিরে রেখেছে ওকে।

রুহির চোখে পড়ল এক ছিপছিপে মিষ্টি চেহারার তরুণী।  সাতাশ-আটাশ বছরের তরুণীর মাঝে আছে এক আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। একহারা, লম্বা বিভার চশমার ওপর নীল চুলের গোছা ঝুলে আছে, কেন যেন মূর্ত দেবী কালীর কথা মনে পড়ল রুহির ওকে দেখে।  

“স্যরি ফর দ্য ইনকনভিনিয়েন্স। কিন্তু কিছু কথা জানতেই হত আমার। প্লিজ, ডোন্ট মাইণ্ড,” বিভা মাথা ঝুঁকিয়ে বলল রুহিকে।

রুহি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আমার সাথে কথা হয়েছে শোয়েব ভাইয়ের। আমারও মনে হয়, ইউ হ্যাভ দ্য রাইট টু নো হোয়াট হ্যাপেন্ড বিটুইন আস। প্লিজ, বি সিটেড।”

কফি খেতে খেতে রুহি তার গল্পটা শুরু করল।

“আমাদের মাঝে ছিল কেবলই বন্ধুতা। আমি জানিনা কেন, কিন্তু শান আরেকটু বেশি কিছু ভেবেছিল। সময়টা তখন ক্লাস ইলেভেন, আমরা কলেজে পড়ি। সে সময় ওর এই পাগলামিটা বেড়ে যায়। আমি বারবার বলেছি, আমরা কেবলই বন্ধু। সে তাও এই ভেবে দিন কাটাতে শুরু করল, আমি ওর সাথে একদিন সম্পর্কে জড়াব।  

ভার্সিটিতে উঠে দেখি, আমাদের কথাটা অনেকেই জানে৷ আমার পরিচয় হয়ে যায়- আইইউটি এর এক ছেলের সাবেক প্রেমিকা । সিম্প্যাথি কুড়াতে শান আমাদের বিষয়ে কথা বলে বেড়াত। আমি বার বার না করেছি ওকে, শোনে নি। আমার তখন নতুন রিলেশন, বুঝতেই পারছেন, এসব কথায় কী হতে পারে। আমি তখন ওকে পুরোপুরিভাবে ছেটে ফেলি জীবন থেকে।

আমি জানতাম না, ওর লাইফে এত ঝড় বইছে। ছেলেটা অনেক চাপা। সে আমাকে বারবার বলেছিল, আমাকে সরিয়ে দিও না; কিন্তু পারিনি। দেখুন, এই ইলিউশান ওর জন্যই ক্ষতিকর হত, আর আমাত কথা তো বাদই।।আমার প্রেমের মাঝে বাগড়া দিত এটা। আমি তো আমার সব রেপুটেশন, রিলেশন স্যাক্রিফাইস করব না ওর ইলিউশানের কারণে, তাই না?”

রুহির দিকে একদৃষ্টিতে রইল বিভা। রুহিকে সে যেভাবে ভাবছিল,রুহি তা নয়। শান ভুল বুঝেছিল রুহিকে।  

“দেখুন মিস বিভা, এটা স্রেফ ওর পাগলামি। সে ষোলটা বছর ধরে একটা ইলিউশান নিয়ে বেঁচে আছে। ওর চিকিৎসা প্রয়োজন। দেখুন, আমার ভার্সিটির প্রেমটা টিকেনি। ভালোবাসার মানুষটা এসব রিউমার শুনে সরে গেছিল। পরে আমার বিয়ে হয়েছিল। এসব রিউমার আমার হাজবেন্ডও শুনেছিল, জানিনা কীভাবে। আমারই কোনো এক জেলাস বান্ধবীর কাজ ছিল সেটা মেবি। আমি তখন পিএইচডি করছি ইংল্যান্ডে। আমার হাজবেন্ডের আবার ছিল সন্দেহবাতিক। আমার পাসপোর্ট সরিয়ে ফেলল সে, আমি বন্দী হয়ে রইলাম বিদেশে। সারাদিন অত্যাচার করত আমার ওপর। আমার কী হবে, বলুন? অনেক কষ্টে দেশে ফিরে ডিভোর্স দিলাম। আমার পরিবার আমারে দূরে ঠেলে দেয়। সে আরেকবার সুযোগ চেয়েছিল, দেইনি। আমাকে ইমোশোনালি ভালনারেবল ভেবে সে সুযোগ নেবে, করুণা করবে- তা হয় না। অবশ্য, শান হয়ত ভালোমনেই নিত, ইচ্ছা করে সে আমার কষ্টের কারণ হয়নি- এটুকু বিশ্বাস আমার আছে। কিন্তু কী বলব, লাইফটা সিনেমা না। কষ্ট সে একাই করেনি, আমিও করেছি, মিস বিভা। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড। আমি এখন আরেকটা রিলেশনে আছি, আমার এটা দ্বিতীয় প্রেম। আমরা শীঘ্রই বিয়ে করব। ওকে প্লিজ বলুন, মুভ অন করতে। আমি লাইফটা আবারো শুরু করতে যাচ্ছি এই বত্রিশ বছর বয়সে, এখন আমি চাই না ওর পাগলামি আমাকে আরো কষ্ট দিক। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, মিস বিভা।”

বিভা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর আস্তে আস্তে বলল, “আপনি ওকে আর একটা সুযোগ দিলেই পারতেন…”

রুহির সুন্দর চেহারায় বিষাদের গভীর ছাপ- “দেখুন, আমরা কার প্রেমে পড়ব, তা কি আমরা নির্ধারণ করতে পারি?”

এই বলেই মেয়েটা উঠে দাঁড়াল, “থ্যাংকস ফর দ্য কফি।”

কিছুদিন কেটে গেছে। আজকে ৩১ অক্টোবর, হ্যালোউইন।

শান মাকসুদ দাড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে। হাতে স্মিরনফের গ্লাস। দরজার সামনে এলোমেলো নাইটিতে বিভা। শান সেজেছিল কাউণ্ট ড্রাকুলা। বিভার ভ্যাম্পায়ার কস্টিউম গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে।

শানকে চেপে ধরেছিল বিভা এরপর। শান কোনো রাখঢাক না রেখেই সব বলেছে ওকে।

“আমি কি করব, বলো বিভা? আমি যা করেছি, ভালোবাসার জন্য করেছি। যখন শুনেছি, আমার জন্য ওর প্রেমটা টিকেনি, সরে গেছি ওর কাছ থেকে। ওর সাথে আমার কথা হয় না আজ বারো বছর। আমি তো জেনেবুঝে ওকে কষ্ট দেইনি, দিয়েছি কি? তবে আমার কী দোষ?”

“তুমি কি এখনো রুহিকে ভালোবাসো?”

“বুকের ভেতর একটা শূন্যতা আছে আমার, সেটার নাম রুহি। এটাকে ভালোবাসা বলে কি না, জানিনা।”

“ডু ইউ ব্লেম হার ফর এভ্রিথিং?”

“কখনোই না, ভালোবাসাতে কোনো দোষ নেই, বিভা। স্বেচ্ছায় বিষপান করেছিলাম, নিজেও পুড়েছি, ওকেও পুড়িয়েছি। কোথা থেকে কী হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না।

প্রেম নহে মোর মৃদু ফুলহার, দিল সে দহন জ্বালা,

তবু তার লাগি নিরজনে বসি গাঁথি অশ্রুমালা।”

বিভার ঠোঁটে হালকা চুমু খেলো শান। ওর নিশ্বাসে অ্যালকোহলের গন্ধ। বিভা কপাল থেকে চুল সরাল, আলতো করে ছুঁয়ে দিল শানের ঠোট। ফিসফিস করে শানের কানে কানে বলল সে,

“স্বর্গ আর নরকের মাঝে একটা জায়গা আছে, পারগেটরি। কিছু আত্মা পারগেটরিতে আটকা পড়ে। তারা না পারে স্বর্গে যেতে, না পারে নরকে ফিরতে।”

“বিভা, আমি এতকাল ধরে পারগেটরিতেই আটকে আছি। কী হবে আমার? আমি রুহির জীবনটা মাটি করেছি। আমারটা ত গোল্লাতেই গেল। আমার কি তবে আর স্বর্গ দেখা হবে না?”

“হ্যা, হবে,” বিভা হাসল, “হ্যালোউইনের রাতে পারগেটরি থেকে অভাগা আত্মাগুলো স্বর্গে যেতে পারে। আজ হ্যালোউইনের রাত, শান। আজকে তুমিও স্বর্গে যাবে।”

“তার মানে আমি আজ মুক্তি পাব?”

বুকের মাঝে ঠাণ্ডা ইস্পাতের স্পর্শ অনুভব করতেই একটু কেঁপে উঠল শান। বিভা হাসল,

“হ্যা, আজকে তুমি আর রুহি দুজনই মুক্তি পাবে। আজ যে হ্যালোউইন।”


Comments