হেলেন
ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ছেড়ে আসা লুথফহান্সার ডিসি-১০-৩০ বিমানটি করাচির জিন্নাহ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়েতে ল্যান্ড করল। বাতাসে তখন বরফের কুচি ভাসছে। পাকিস্তানের সিন্ধে এক গোড়াখ পাহাড় ছাড়া বরফ খুব কম জায়গাতেই পড়ে। সেখানে মাইনাস পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দেখে একটু বিস্মিতই ১৯৭৪ সালের করাচি।
এয়ারপোর্টে ঈগলের মত তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে তাজ খান জতুই। তালঠ্যাঙা এই বালুচের মন-মেজাজ বেশ খারাপ। এই প্লেনে আসছে দুই গাদ্দার বাঙালি, এই দেশ থেকে নিয়ে যেতে দেশের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস পপস্টার আর এক লেখিকাকে। আরেহ, হামিদা বানুর মত নালায়েক আওরাতকে নিয়ে যাবি, যা; কিন্তু নূরীকে ফেরত নিয়ে যাবি? নূরীর গান ছাড়া ললিউডের সিনেমা জমে নাকি? না, মহিলা তাও গোঁ ধরেছে, সে ‘মাতৃভূমি’তে ফিরবে। আরেহ কী আছে ওখানে? ওখানে ওর গান শুনবে কে, আর সিনেমাই দেখবে কে? এ বছরই তো না খেয়ে মারা গেলে হাজার হাজার মানুষ; এখনো হয়ত দেখা যাবে পথে পড়ে আছে কঙ্কালসার মানুষের লাশ।
হ্যাঙারের বাইরে দাঁড়িয়ে হিহি করে কাঁপছে তাজ। সে মনে মনে গালি দিল তার ওপরওয়ালাকে এমন একটা বাজে কাজে তাকে পাঠানোর জন্য। কিন্তু কিছু তো করার নেই। মছুয়া বাঙালির হাতে মার খেয়ে দেশে ফেরা সৈনিকদের একজন সে- এসব ফুটফরমাশের চেয়ে বড় কোনো কাজে তো তাকে পাঠাবে না।
প্লেনের ভেতর নাতিশীতোষ্ণ অবস্থা গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে আলী আশরাফের গায়ে। পাকিস্তানে যেতে হবে, এটা শুনে রীতিমত মেজাজ চড়ে গেছিল ওর। দশদিন আগে যখন সবকিছু ঠিকঠাক করে ওর হাতে তুলে দিচ্ছিল ফরেন মিনিস্ট্রির আমলারা, তখন থেকেই ওর বাম পায়ে থেকে থেকে কে যেন গরম ছুরি চেপে ধরছে। তিনবছর আগে পাওয়া ক্ষতগুলো যেন দ্গদগে ঘা হয়ে আছে এখনো। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে আসার পথে একটু তন্দ্রামত এসেছিল ওর। একটা তীব্র আর্তনাদ করে তন্দ্রা কেটে গেছিল ওর। ববকাট করা কালো চুলের সুন্দরী এয়ারহোস্টেস ছুটে এসে জিজ্ঞেস করেছিল কী হয়েছে ওর।
“নাথিং, জাস্ট আ ব্যাড ড্রিম,” চোস্ত জার্মানে দ্রুত ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল সে। ইন ফ্লাইট শেভাল ব্লঙ্কে চুমুক দিয়ে মাথাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়েছিল সে।
“আবারো সেই পুরনো দুঃস্বপ্ন, আশরাফ?”
পাশে পাথরের মত বসে একমনে বইয়ের পাতায় চোখ আটকে রেখেছিল শ্যামল বৈদ্য- জাঁ পল সার্ত্রের ‘Nausea’ পুরোটা সময় সে অন্য কোনো একটা জায়গায় হারিয়ে গেছিল। শ্যামলকে দোষ দেয় না আশরাফ, সে জানে এই কাজে পাকিস্তানে আসার জন্য রীতিমত পররাষ্ট্র সচিবকে ধরে তদবির করেছে সে। নূরী অথবা বেগম হামিদা বানুকে দেশে ফেরত নিয়ে ওর তেমন কোনো তাগিদ নেই, এটা ওর সাইড মিশন। শ্যামলের প্রধান ইচ্ছেটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত।
“হুম,” আশরাফের সংক্ষিপ্ত উত্তর। শ্যামল আবার বইয়ের পাতায় চোখ রাখল। সাড়ে নয়ঘণ্টার প্লেন জার্নি, এর মাঝে ছয়ঘণ্টাই সে বইয়ের দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছে। কিন্তু আশরাফ জানে, সে একটা অক্ষরও পড়েনি। যদি পড়ত তাহলে সে বুঝত, বইয়ের প্রথম লাইনেই ওর নিজের মনের কথাটা লেখা আছে- Something has happened to me, I can’t doubt it any more.
শ্যামলের মাথায় তখনো ঘুরছে একটা দৃশ্য। সে বসে আছে পদ্মার পাড়ে, হেমন্তের এক মরা বিকেলে। পাশে বসে আছে চিত্রা। চিত্রার এলোচুল উড়ছে প্রমত্তা নদীর হাওয়ায়।
আচ্ছা শ্যামলদা, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?
শ্যামল উত্তর দেবার আগেই বারবার ঘোলা হয়ে যাচ্ছে দৃশ্যটা; প্রতিবার সে চেষ্টা করছে মনে করতে সে কী উত্তর দিয়েছিল- পারছে না। তার মাথায় ঘুরছে শুধু সেই একটা কথা- আচ্ছা শ্যামলদা, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?
পাকিস্তানের এয়ারস্পেসে প্রবেশ করার আগে আশরাফ আরেকবার শেভাল ব্লঙ্ক ১৯৫৪ চেয়ে নিল এয়ারহোস্টেসের কাছ থেকে। শ্যামল বইটা নামিয়ে বলল, “আশরাফ, তোর মাথাটা একদম গেছে।”
“তুই একদম সায়মার মত কথা বলছিস শ্যামল,” আশরাফ মাথা নাড়ল। ওর মনে পড়ল ১৯৫৭ সালে ছেড়ে আসা কলেজজীবনের কথা। ওর পাশের বাসায় থাকতেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রিডার। তার একমাত্র মেয়ে ছিল সায়মা। কলকাতা থেকে পালিয়ে আসা এক মোহাজের পরিবারের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে নারাজ ছিলেন ভদ্রলোক। সেকারণে বাড়ি থেকে পালিয়ে ফৌজে ঢুকেছিল আশরাফ। প্রেম বলে কথা, আজো ভুলতে পারেনি সে সায়মাকে। ভুলতে না পারার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ত সায়মার সাথে বাঁধের ধারে হাঁটা নয়- ওর নিথর শরীরটা; যেটার সাথে আশরাফের দেখা হয়েছিল বাড়ি থেকে পালানোর আঠারো বছর পরে, এক নামহীন বাঙ্কারের ভেতর।
“আহ, সায়মা… ওর ভালো নিমকি বানাত রে, একটু কালোজিরা দিয়ে। প্রতিটা নিমকিতে গুনে গুনে আঠারোটা কালোজিরা থাকত, জানিস?”
আশরাফ শ্যামলের দিকে তাকাল, ওর কটকটে বাদামি চোখের মধ্যে একটা নিরব জিজ্ঞাসা- কোন আহাম্মক একটা নিমকিতে কয়টা কালোজিরা আছে সেটা গুনতে যায়?
কিন্তু শ্যামল জানে আঠারোটা কালোজিরার মাহাত্ম্য- আশরাফ বাড়ি ছেড়েছিল আঠারো বছর বয়সে।
একটা গুমোট নৈশব্দ ভেসে বেড়ায় দুই বাল্যবন্ধুর মাঝে। সেটা ভাঙে করাচিতে পৌঁছানোর ঘোষণা আসার পর।
ডিসি-১০-৩০ প্লেনটার দিকে তাকিয়ে থাকে তাজ খান জতুই। ওর ঠোঁটের ফাঁকে পুড়ছে কে-২ সিগারেট। প্লেন থেকে নামতে থাকা প্রতিটি যাত্রীর দিকে তার চোখ। ওর চোখ আটকে যায় শেষের নেমে আসা দুই যাত্রীর দিকে। একজন মাঝারি উচ্চতার, তার শ্যামলা গায়ের রঙ বলে দিচ্ছে সে মছুয়া বাঙালি। হালকা-পাতলা গড়ন, সপ্রতিভ চলাফেরা। কিন্তু তার পাশের জন রীতিমত এক দানব। নূরী আর হামিদা বানুকে ফিরিয়ে নিতে যদি কুস্তি লড়তে হয়, এই লোক সেটাও পারবে। তবে সৌভাগ্যের কথা, তার হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে তার, বাম পা খোড়া তার।
তাজ খান তার হাতের লিস্টে চোখ বোলাল- এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি কাদের রিসিভ করতে এসেছে সে। তার ইউনিফর্মই যথেষ্ট মছুয়াদের বোঝানোর জন্য যে সে তাদের জন্যই এসেছে এখানে।
শ্যামল বৈদ্য- ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।
কর্নেল আলী আশরাফ মীর- ডিরেক্টরেট অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স বাংলাদেশ।
তাজ খান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল লিস্টের দিকে। মছুয়াগুলো এ কাদের পাঠিয়েছে? একজন সাংবাদিক আর এক খোঁড়া কর্নেল? অবশ্য ওদের দেশে খোড়া লোকও কর্নেল হয়- হে হে হে…
“আসসালামু আলাইকুম, আমি ক্যাপ্টেন তাজ খান জতুই,” তাজ অন্যসময় হলে এতটা পাত্তা দিত না, কিন্তু ওর চাইতে এক হাত লম্বা আর দুইহাত চওড়া আলী আশরাফকে ঘাটাতে সাহস পেল না। সে উর্দুতে কথা বললেও উত্তরটা এলো ইংরেজিতে।
“আপনাদের এখন আমি নিয়ে যাব করাচি ক্যানটনমেন্টে, কিছু সাওয়াল করা হবে আপনাদের। আশা করি আপত্তি নেই আপনাদের?”
“আমরা টায়ার্ড। তোমার বস, আইএসআই সেকশন চিফ কর্নেল আসকারিকে বলবে আমি প্যালেস হোটেলে উঠেছি। এসে যেন দেখা করে যায় আমাদের সাথে,” বলে গটগট করে দাঁড়িয়ে থাকা ভক্সওয়াগনে উঠে বসল আশরাফ, সাথে সাথে শ্যামল। হা’ করে তাকিয়ে রইল তাজ খান, এতটাই স্তব্ধ সে যে বুঝতেও পারল না কী হলো এইমাত্র।
গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে পশতুতে বলল আশরাফ, “ডিপো হিল স্টেশন দিয়ে বের হয়ে প্রফেসর গফুর আহমেদ রোড হয়ে গুলশান-ই-ইকবাল হয়ে যাবে প্যালেস হোটেলে।”
এয়ারপোর্ট থেকে যেকোনো সেনাচৌকি এড়িয়ে যাবার এটাই একমাত্র রাস্তা। পাঠান ড্রাইভার নিজের দেশি মানুষ ভেবে গপ্পো জুড়ে দিতে চাওয়ার ইচ্ছেটা বেশ কষ্টে দমন করল।
হোটেলের আসার পথে চারদিকে চোখ মেলে তাকিয়ে রইল দুজনই। করাচি ক্যান্টনমেন্টের সামরিক গোয়েন্দা উইং-এ অফিসার-ইন চার্জ ছিল আশরাফের। সেখান থেকে একগাদা ফাইলের ছবি তুলে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল সে একাত্তরে। কাজেই ওখানকার সব খবর নখদর্পণে তার।
শ্যামল ছিল দৈনিক সংবাদের এন্টারটেইনমেন্ট জার্নালিস্ট। একত্রিশে মার্চের রাতে সে ছিল সংবাদের অফিসে, সাংবাদিক শহীদ সাবেরের সাথে। রাতে মিলিটারি পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে দিলে সে কোনোমতে জান বাঁচায়, শহীদ সাবের মারা যান আগুনে পুড়ে। এরপর সে সোজা চলে যায় রাজশাহীতে, সেখান থেকে ভারতে। কলকাতায় এসে তার দেখা হয় বাল্যবন্ধু মেজর আলী আশরাফের সাথে- পঁয়ষট্টির যুদ্ধের ওয়ারহিরো। নাম গোপন করে ছদ্মবেশে ছিল সে, কারণ তার কাছে থাকা গোপন সামরিক তথ্য নেবার জন্য ভারতীয়রা ওকে খুঁজছিল। পরে সেক্টর সাতে মেজর কাজী নুরুজ্জামানের সাথে যুদ্ধ করেছিল দুজনই। স্বাধীন দেশে যুদ্ধাহত আশরাফ দায়িত্ব পায় প্রথমে রক্ষীবাহিনীতে, নুরুজ্জামানের সহকারী হিসেবে। পরে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিএফয়াই গঠিত হলে ১৯৭৩ সালে সে রক্ষীবাহিনী ছেড়ে যায়। ওদিকে শ্যামল দেশে ফিরে দৈনিক সংবাদেই থেকে যায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে। পাকিস্তানি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি আর প্রকাশনার জগতের জালের মত ছড়ানো শ্যামলের নেটওয়ার্ক।
হোটেলে এসে নিজেদের রুমে ঢুকে পড়ল দুজন। শ্যামল চান করতে ওয়াশরুমে ঢোকার পর আশরাফ ব্যাগ থেকে সব জিনিসপত্র বের করল। ব্যাগের ভেতর থেকে বের হলো একটা স্ক্রু-ড্রাইভার। সে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে রুমের টেলিফোন সেট খুলে তার ভেতর থেকে আড়িপাতার যন্ত্রটি খুলে ফেলল। এরপর ফোন করল করাচি ক্যান্টনমেন্টের কর্নেল আসকারিকে।
“আশরাফ, এসেই তুমি কী শুরু করেছ এসব?”
“আসকারি, আমাদের পিছু পিছু এয়ারপোর্ট থেকে এসেছে একটা সাদা নিশান, নাম্বার ৬২৭৬০। সেটা যেন আমি আমার চোখের সামনে আর না দেখি। হোটেল রিসিপশনের বাদামি স্যুটের পাঞ্জাবি, ছাগলের মত দাড়ি আছে যার, তাকেও যেন না দেখি। হোটেলের বাইরে তিনজন টিকটিকি রেখেছ, সরিয়ে নিও। আর তাজ খান জতুই একটা আস্ত বলদ, ওকে দিয়ে ফরেন ডেলিগেশন এরপরে রিসিভ করতে পাঠিও না।”
“আশরাফ, আশরাফ, দিস ইজ নট ইউর কান্ট্রি এনিমোর। আই হ্যাভ আ জব, ওকে? আমাকে তোমাদের চলাফেরা রিপোর্ট করতে হবে হেডকোয়ার্টারে। নইলে জেনারেল শমশের আমার চামড়া তুলে নেবেন।”
“জেনারেল শমশরের বিবি বোধহয় জানেন না তিনি জলন্ধরের এক বাঈজীকে দুসরা শাদি করেছেন। উনার কানে সুখবরটা দিয়ে দেব নি আমি। আর হ্যাঁ, করাচির জিওসি জেনারেল আকবর যে দুবছর ধরে এলএসডি সেবন করছেন, সেটা সম্ভবত তোমাদের নিউজপেপারের প্রথম পেইজে খুব সুন্দর মানাবে।”
“শালা ব্ল্যাকমেলার!”
“ওকে, যা বলার বলেছি। এখন আমাদের অফিশিয়াল ট্রিপের সময় যাচ্ছেতাই করো, সমস্যা নেই। আমার বন্ধু শ্যামল একটা ব্যক্তিগত কাজেও এসেছে এখানে। সেটা করার জন্য মাঝে মাঝে আন-অফিশিয়াল ভিজিটে বের হবো আমরা। তখন কোনো টিকিটিকি আমি দেখতে চাই না, এর কথা কোনো রিপোর্টেও দেখতে চাই না। ওসব দেখলে খুব একটা ভালো হাল করব না আমি তোমাদের করাচি গ্যারিসনের। আর হ্যাঁ, রাতে বেগম বাজারের ঘোড়ির চোলাই দুধ বেচার দোকানটায় এসো ঠিক এগারোটায় যদি দেখা করতে চাও।”
ফোনটা ক্রেডলে নামিয়ে রাখল আশরাফ। বাইরে ঝিরিঝিরি তুষার পড়ছে। করাচির সবচেয়ে পুরনো হোটেলের কার্নিশে জমছে পেঁজা তুলোর মত তুষার। আশরাফ সেদিকে তাকিয়ে থেকেই হাঁক দিল, “শ্যামল, তোর চান হল? আমি যাব এরপরে, তাড়াতাড়ি বের হ।”
“আসছি!”
মাদি ঘোড়ার চোলাই দুধ মধ্য এশিয়ার লোকের প্রধান পানীয়। হাড়জমানো ঠাণ্ডার মাঝে এ জিনিস পান করে নিজেদের গরম রাখে ওরা। করাচির প্রধান বাজারের এক কোণে ছোট্ট একটা দোকানে এ জিনিস বেচে এক বুড়ো। রাতে ডিনার শেষে আশরাফ চলে গেল সেখানে। আর শ্যামল টেলিফোন ডাইরেক্টরি নিয়ে বসল। সে কল করল পাকিস্তানের এক প্রধান কবিকে।
“কমরেড, আছেন কেমন?”
ওপাশের মানুষটি চেনা কণ্ঠস্বরে যারপরনাই বিস্মিত হলেন, “ইয়া খুদা, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?”
“না কমরেড, আমি শ্যামল।”
“শ্যামল! তুমি পাকিস্তানে?”
“জ্বি কমরেড,” হাসল শ্যামল, “আজই এলাম। নূরী আর বেগম হামিদা বানুকে দেশে নিয়ে যাব।”
“ওহ, ওরা চলে যাবে তাহলে। ভালোই হবে, মোল্লারা তো হামিদার পেপারের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছিল। ওকে তো পেপারটাই বেচে দিতে হলো শেষকালে। ও চলে গেলে বড্ড মন খারাপ হবে।”
“কমরেড, আপনি তো ভুট্টোর কালচারাল অ্যাডভাইজার ছিলেন এডুকেশন আর কালচার মিনিস্ট্রিতে। ছাড়লেন কেন পদ দুইটা?”
“আর বলো না, ভুট্টো বেঈমানি করেছে আমাদের চেতনার সাথে। আমাকে ও ওর রক্ষিতা বানাতে চায়। বলে, আমরা পূর্ব পাকিস্তান হারিয়েছি, আমরা ভালো মুসলমান হলে এটা হত না। বলো তো শ্যামল, আমরা বাংলায় কোন কাজটা মুসলমানের মত করেছিলাম? আর হ্যাঁ, শ্যামল, তোমরা এখনো ভুট্টোকে মাথায় তুলে রাখছ দেখলাম। ঢাকায় গিয়ে দেখি এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পর্যন্ত কয়েক সারি করে মানুষ চিয়ার করছে ওর জন্য। একটা নতুন দেশে এসব কী হচ্ছে?”
১৯৭৪ সালে কবি ঢাকায় এসেছিলেন ভুট্টোর সফরসঙ্গী হয়ে। ভুট্টোর ৫৬ ঘণ্টার সফর তৈরি করেছিল একাধিক বিতর্ক।
“কমরেড, দেশে অনেক কিছুই হচ্ছে। যা হচ্ছে, তা আর বলার মত না। সামনে কি আছে কে জানে!” শ্যামল ধীরে ধীরে আবৃত্তি করল কবির লেখা হাম কে তেহরে আজনাবি কবিতার দুইলাইন-
বসন্তের শ্যামলিমা আবার দেখব কবে দুচোখ ভরে,
আর কত বর্ষা এলে রক্তের দাগ সব যাবে ধুয়ে?
“কমরেড, আপনার সাহায্য দরকার। আমি একজনকে খুঁজতে এসেছি।”
ওপাশের কণ্ঠস্বরে সামান্য কম্পন, “কাকে?”
“আপনি তো জানেন যুদ্ধের পর ৩০-৪০ জন বীরাঙ্গনা চলে এসেছিল পাকিস্তানে, তারা নিজেদের দেশে তাদের সাথে হতে থাকা নিন্দাবাদ নিতে পারে নাই আর। আমি তাদের একজনকে খুঁজতে এসেছি।”
“শ্যামল, তুমি তো বেটা খড়ের গাদায় সুঁই খুঁজতে এসেছ। এখন কোথা থেকে কীভাবে কাদের খুঁজব?”
“আমার কাছে একটা খবর আছে। আমি যাকে খুঁজছি সে এখানে এসে একটা সেলাই শেখানোর স্কুলে কাজ নিয়েছে। এটুকুই জানি। সে নামও পালটে ফেলতে পারে। এখন আমাকে এ তথ্যটা যোগাড় করে দিতে হবে কমরেড- দুইবছর আগে করাচির কোন সেলাই শেখানোর স্কুলে ইন্সট্রাকটর হিসেবে একটা বাঙালি মেয়ে কাজ নিয়েছে।”
“শ্যামল, কাজটা কঠিন আর সময়সাপেক্ষ। আমি তোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করব।”
“থ্যাংক ইউ কমরেড, লাল সালাম।”
ফোনটা ক্রেডলে নামিয়ে রাখল শ্যামল। পকেট থেকে এক প্যাকেট মার্লবোরো ভার্জিনিয়া বের করল সে। দুই ঠোঁটের মাঝে সেটাকে চেপে ধরে আগুন জ্বালাল সে। দুই টান দিয়ে তার সামনে খোলা ডাইরেক্টরি থেকে আরেকজনের নাম্বার বের করল।
আশরাফ হোটেলে ফিরল রাত দুটোর দিকে। সে এসে শ্যামলকে তখনো টেলিফোন হাতে দেখতে পেল।
কোনো কথা না বলে আশরাফ চলে গেল পুলে, রাতটা সে পুলের পাশে চেয়ারে বসে কাটাবে। শ্যামলকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হচ্ছে না ওর।
জেবুন্নেসা স্ট্রিট, করাচি।
বেগম হামিদা বানু চিনেমাটির নকশাকাটা কাপে সুগন্ধি চা ঢেলে দিলেন আশরাফকে। আশরাফ ধন্যবাদ জানিয়ে চায়ের কাপ হাতে তুলে নিল। একহারা, ছিপছিপে হামিদা বানু তসলিম সহকারে সোফায় বসলেন। চল্লিশের একটু বেশি বয়স উনার, মাথার চুলে সামান্য রুপোলি ছোপ পড়েছে তার। পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রখ্যাত নারীবাদী লেখিকা হামিদা বানু মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার প্রতিবাদে কলাম লেখায় দু’বছর জেল খেটেছেন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন- সবার চোখে তিনি গাদ্দার। বাঙালি পরিবারের মেয়ে তিনি, এজন্য তার ‘অপরাধ’ সবার চোখে আরো বেশি পড়ছে।
“আপা, আপনার কলামগুলো পড়তাম আমি যুদ্ধের সময়। আমার কাছে পেপার কাটিং এখনো আছে।”
“তাই?” হামিদা বানু একটু অবাক, সেনাবাহিনীর লোক পেপারের কলাম পড়ে এ জিনিসটা তার কাছে নতুন মনে হলো।
“হ্যাঁ,” আশরাফ মুচকি হাসল, “ডেইলি আরশিনামা-এর রোববারের কলামগুলোর কাটিং বিশ পাউন্ড দিয়ে কিনে রেখেছিলাম আমি। জিনিসগুলো দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছিল। আমার কাছে রাখা আচ্ছে ওগুলো। ঢাকায় ফিরে একদিন মনে করিয়ে দিয়েন আমাকে, আমার নাখালপাড়ার বাসায় নিয়ে যাব আপনাকে একদিন। আমার বউ, জিনাত আপনার বড় ভক্ত।”
হামিদা বানু অত্যন্ত পুলকিত হলেন এ কথায়, “তাই নাকি? আমি তো ভাবতাম ঢাকায় আমার লেখা কেউ তেমন একটা পড়ে না।”
আশরাফ ফিক ফিক করে হাসতে লাগল, “জিনাত তো বাঙালি না আপা; ও কোহাটের মেয়ে, বড় হয়েছে লাহোরে। আমি ওকে চিনেছি যখন আমার পোস্টিং ছিল লাহোরে; ও লাহোর ভার্সিটির অ্যালমা মেটার।”
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন হামিদা বানু। আশরাফের সাথে আলাপের শুরুতেই জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি- ওর গ্রামের বাড়ি কই। উত্তরটা কলকাতা শুনে রীতিমত চমকে গেছিলেন তিনি।
আমি মোহাজের, আপা। আমার বাবা মারা গেছিলেন ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে। কাকাদের সাথে রাজশাহীতে এসে উঠেছিলাম। আমার মা আবার কিন্তু সিন্ধি; এজন্যই অমন দশাসই চেহারা আমার, হে হে হে…
“আচ্ছা, আশরাফ সাহেব,” হামিদা বানু হাত থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি নিজে মোহাজের, আধা সিন্ধি তার ওপরে। আপনার অর্ধাঙ্গী পাঠান। এত মাল্টি-কালচারাল অ্যাটমোস্ফিয়ারের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি আপনার এই ডেডিকেশন কীভাবে জন্মালো? মানে, কারণ কী? আপনার তো বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস থাকার কথা নয়। এরপরেও সবকিছু ছেড়ে বাংলাদেশে গেলেন কেন আপনি?”
আশরাফের হাসিটা চওড়া হলো আরো, “জগতে দুটো ভাগ আছে আপা- জালেম আর মজলুম। আমি মজলুমের পক্ষের লোক। ঠিক যেজন্য আদ্রেঁ মলেরো মুক্তিযুদ্ধ করতে চেয়েছেন, যে কারণে অ্যালেন গিনসবার্গ, কবিতা লিখেছেন, যে কারণে রবিশঙ্কর, হ্যারিসন, বব ডিলান গান গেয়েছে- আমি সেকারণে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছি। আর কোনো কারণ নেই।”
খেয়াবান-ই-রুমি স্ট্রিট, ক্লিফটন, করাচি।
করাচির সবচেয়ে অভিজাত এলাকা ক্লিফটন। বিদেশি দূতাবাস, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, সচ্ছল বাসিন্দা- একটা পুরোপুরি উন্নত, সমৃদ্ধ এলাকা এই ক্লিফটন। পপ-তারকা নূরীর বাড়ির সামনে এসে থামল একটা কালো ভক্সওয়াগন। ড্রাইভওয়েতে একটা রুপোলি মার্সিডিজ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যারপরনাই খুশি হলো শ্যামল- এই গাড়ির মালিককে সে বিলকুল চেনে। ঝর্ণা, ললিউডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চিত্রনায়িকা। ইনিও বাঙালি। যাহ, দুজনকেই একসাথে পাওয়া গেল। অনেকদিন দেখা হয়নি এদের সাথে।
ওকে দেখে দৌড়ে এসে নূরী জড়িয়ে ধরল। সোফায় বসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন ঝর্ণা, তিনি উঠে এসে বললেন, “শ্যামলদা করাচি এলে কবে? আর তুমি অমন শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেলে কীভাবে?”
“এইতো কালকেই এলাম,” মৌজ করে সোফায় বসে সিগারেট ধরাল শ্যামল, “তা অ্যাদ্দিন পর দেখা। তোমরা আছ কেমন সবাই?”
নূরী হাসতে হাসতে বলল, “এতক্ষণ চিন্তায় ছিলাম। এইতো দুদিন আগে এলেও দেখতে পেতে আমার বাড়ির সামনে মানুষের জটলা- সবার এক কথা, যেতে দেব না। এখন তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আটঘাট বেধেই এসেছ। আমার আর চিন্তা না করলেও হবে। নিশ্চিন্তে দেশে ফিরতে পারব।”
“তা আর বলতে!” নিজের সাইডব্যাগ থেকে এক তাড়া ফাইল বের করল শ্যামল, “তোমার কন্ট্রাক্টের কাগজ। এসব সাইন করে দিলেই তুমি মুক্ত। এরপর আর দুদিন লাগবে সব গোছাতে। সামনের শুক্রবার রাত তেহরানের ফ্লাইট। তেহরান থেকে দেশে ফিরব আমরা।”
“কেন? আমি তো শুনেছিলাম করাচি টু ঢাকা প্লেন চালু হয়েছে। তা তেহরান ঘুরে যাব কেন?”
“কারণ আমরা পিআইএকে ঠিক ট্রাস্ট করিনা। এক্সট্রা খরচ যা হবে, সেটা স্পন্সর করার মানুষ আছে।”
ঝর্ণা ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে। তিনিও দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান সরকার আটকে দিয়েছে তার পাসপোর্ট। ঝর্ণা ললিউডের প্রাণ- তার ওপর কোটি কোটি রুপি ইনভেস্ট করে রেখেছে পাকিস্তানের প্রযোজকরা। এজন্য তাকে ফিরতে দেবে না পাকিস্তান। নূরীকে নিয়েও কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। মুফতে সুযোগ বুঝে বড় বড় টোপ দিয়েছিল বলিউডের হোমড়াচোমড়ারাও। এই গোটা উপমহাদেশের অন্যতম পপতারকা নূরী, ওকে নিতে পারলে বিরাট লাভ হবে সবারই। শেষ পর্যন্ত রেখে যেতে হবে ঝর্ণাকেই। শ্যামলের ইচ্ছে হলো, ঝর্ণাকে লুকিয়ে পাচার করতে বাংলাদেশে। আশরাফ ঝানু গুপ্তচর, সে নিশ্চয়ই পারত এমন কিছু করতে। কিন্তু বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষও এই আপোষরফা মেনে নিয়েছে, এমন সময়ে ঝর্ণাকে নিয়ে উপরি ঝামেলা বাধানোর কোনো মানে হয় না।
ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল শ্যামল। সে জানে ঝর্ণা এখানে বাংলাদেশের চাইতেও আরামে থাকবে। কিন্তু খাঁচার সুখ দেখিয়ে কি আর বনের পাখিকে মানানো যায়?
“শ্যামলদা, তুমি আমাকে যে কাজটা করতে বলেছিলে,” শ্যামলের জন্য পেস্ট্রি প্লেটে তুলে দিতে দিতে বলল ঝর্ণা, “আমি খোঁজ নিয়েছি। করাচির সব সেলাই শেখার স্কুলে এই খবরটা নেয়ার জন্য আমি আমার এজেন্টকে বলেছিলাম। সে আমাকে একটা লিস্টি দিয়েছে।”
শ্যামল নড়েচড়ে বসল কফির মগ হাতে। নূরীর হাউজকিপারের বানানো ব্ল্যাক কফির সুখ্যাতিতে তামাম করাচি মশহুর।
“মোটমাট বারোজনের নাম এসেছে আমার কাছে। এর মধ্যে তুমি যে স্পেসিফিক ডেস্ক্রিপশন দিয়েছিলে- সেটা মিলেছে একজনের সাথে।”
হ্যাঁ, চিত্রার একটা বর্ণনা ফোনে দিয়েছিল শ্যামল- পটলচেরা চোখ, মেদহীন ছিপছিপে শরীর, লম্বা কালো চুল, তামাটে ফর্সা গাত্রবর্ণ আর ঠোঁটের ওপর একটা তিল, মেরিলিন মনরোর মত। শ্যামল ওকে ডাকত পদ্মাপাড়ের মনরো বলে।
“মেয়েটার নাম আসমা। বাহাত্তরে এসেছে করাচিতে। মুসা কলোনিতে থাকে এক বৃদ্ধার পরিচারিকা হিসেবে, পাশাপাশি সেলাই স্কুলে কাজ শেখায়। এক্সিলেন্ট কাজ করে নাকি সেই মেয়ে। বেশ পরিচিত মুখ মুসা কলোনিতে; কিন্তু কোনো পুরুষকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। আর একটা গুজব তো আছে, সে নাকি যুদ্ধের সময় কোন ব্রিগেডিয়ারের…”
হাত তুলে ঝর্ণাকে থামিয়ে দিল শ্যামল, বাকিটা শুনতে চায় না সে আর।
“ঠিকানাটা দাও তো আমাকে, ঝর্ণা। আমি যাব।”
একটা কাগজ শ্যামলকে দেয় ঝর্ণা, শ্যামল উঠে যায়। ঝর্ণার বেড়ে দেয়া পেস্ট্রি অবহেলায় পড়ে থাকে প্লেটে।
আই. আই. চুন্দ্রিগড় স্ট্রিট, করাচি।
পাকিস্তানের ওয়াল স্ট্রিট ডাকা হয় এই জায়গাকে। রাস্তার দুধার দিয়ে চলে গেছে করাচির সব ব্যাঙ্ক, স্টক এক্সচেঞ্জ আর প্রধান কর্পোরেট হাউজগুলো। এখানে প্রায়ই আসতে হত আশরাফকে, করাচি স্টক এক্সচেঞ্জে যাতে ভারতীয় চরেরা গোলমাল না করতে পারে সেজন্য প্রায়ই নজর রাখা হত ওখানে। জিন্নাহ স্ট্রিট থেকে মোড় ঘুরতেই ওর নজরে পড়ে মেরিওয়েদার ক্লক টাওয়ার, পুরনো করাচি শহর থেকে ইউরোপীয়দের কোয়ার্টারের বিভাজন নিশ্চিত করার জন্য যা স্থাপন করে গেছিল ব্রিটিশরা। ক্লক টাওয়ারের বাদামি গড়নের দিকে এক নজর তাকাল সে, ওর জখম হওয়া পা নিয়ে ল্যাম্ব্রেটা স্কুটার চালানো একটু কঠিনই বটে। কিন্তু এর চাইতে ভার্সেটাইল বাহন করাচিতে আর পাবেনা সে, সেজন্য সকালেই হোটেল থেকে এটা ভাড়া করে আনিয়েছে সে।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উঁচু ভবন হাবিব ব্যাঙ্ক প্লাজার সামনে স্কুটার পার্ক করল সে। পকেটে হাত বুলিয়ে দেখল, চাবি এনেছে নাকি সে। সে ব্যাঙ্কে ঢুকে সোজা চলে গেল ম্যানেজারের কাছে।
“আপনাদের সেইফ ডিপোজিট বক্স ১৩৯-৮৭৬-১০৭৫ এর জন্য এসেছি আমি।”
ম্যানেজার তার ঝানু চোখ বোলাল আশরাফের ওপর। রেজিস্টার বের করে বলল, “আপনি মিসেস জিনাত মীরের সেইফ ডিপোজিট বক্সের জন্য এসেছেন?”
“হ্যাঁ,” আশরাফ উত্তর দিল, “বক্সটা কো-লিজার আমি- কর্নেল আলী আশরাফ মীর।”
“ওকে,” ছবির সাথে মিলিয়ে নিল আশরাফ, সই করল প্রয়োজনমত। ম্যানেজার তাকে নিয়ে গেল ভল্টের ভেতর।
“এই যে আপনার সেইফটি ডিপোজিট বক্স, মি. মীর।”
এরপর ধীরে সুস্থে সেইফ-ডিপোজিট বক্সের কম্বিনেশন কোড মিলাল আশরাফ, চাবি ঘুরিয়ে বক্স খুলল। ভেতর থেকে বের হলো একটা ডায়েরি।
আশরাফ কিছুক্ষণ লাল চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরিটার দিকে তাকিয়ে রইল।
“বোকা মেয়ে, তোমাকে কে বলেছিল এত ঝুঁকি নিতে?”
আশরাফের বকা খেয়ে হাসছিল জিনাত। আশরাফ পালিয়ে এসেছিল একাত্তরের এপ্রিলে। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা অফিসারদের রেখে আসা পরিবারের ওপর ভয়াবহ মানসিক নির্যাতন চালাত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কিন্তু জিনাত নিরাপদেই ছিল লাহোরে। তার বাবা খাইবারের প্রভাবশালী গোত্রপতি, আর তিনি বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই আশরাফের সাথে তার মেয়ের ডিভোর্সের আয়োজন করছিলেন। জিনাত কোনো উচ্চবাচ্য করেনি তখন; লাহোরের বাসায় নিজের ঘরে সময় কাটিয়েছিল সে। মাস চারেক পর পিতার যখন বিশ্বাস জন্মাল, তার মেয়ে গাদ্দারটার সাথে সব পাট চুকিয়েছে; তখন জিনাত গোপনে প্লেনের টিকেট কাটাল তার এক বান্ধবীকে দিয়ে। সেপ্টেম্বরে সে এক কাপড়েই পালিয়ে গেল লন্ডনে। লন্ডন থেকে তার পরবর্তী গন্তব্য ছিল কলকাতার সল্টলেক- তখনকার বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। আশরাফের সাথে ওর দেখা হয়েছিল আগরতলায় বাংলাদেশ ফিল্ড হসপিটালে- যখন এক পায়ে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে পড়েছিল সে।
এবার আসার আগে জিনাত বলে দিয়েছিল ওকে, আসার সময় যেন লাহোরে থাকা দিনগুলোতে জিনাত যে ডায়েরি লিখেছিল, তা নিয়ে আসতে হাবিব ব্যাঙ্কের সেইফ ডিপোজিট বক্স থেকে। নিরীহ বাঙালিদের ওপর চালানো অন্যায় নিপীড়নকে কীভাবে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পশ্চিমে উপস্থাপন করছিল, সাধারণ পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে দেখছিল মুক্তিযুদ্ধকে- তার এক দারুণ বর্ণনা ছিল ওর ডায়েরিতে।
ডায়েরিটা হাতে নিয়ে আশরাফের মনে হল, জিনাতকে সে ছুঁয়ে আছে তার দুহাতে।
“স্যার, সব ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ,” আশরাফ তার জিনিস বুঝে পেয়েছে, এমন স্টেটমেন্টে সই করতে করতে মাথা নাড়ল।
শ্যামল বসে আছে হোটেলের রুমে। আশরাফ এসে দেখল, শ্যামল স্তব্ধ হয়ে আছে, ওর মুখে জমেছে ঘনকালো মেঘ। নীলচে ধোঁয়া ওর মাথার চারপাশে তৈরি করেছে এক অতিপ্রাকৃতিক আবহ। কটা সিগারেট পুড়িয়েছে শালা যে এত ধোঁয়া হয়েছে? শ্যামলের ক্লিনশেভ চোয়াল ঝুলে আছে দুশ্চিন্তায়।
“শ্যামল, ক্লিফটনে কিছু হয়েছে?” আশরাফ গিনিজ বিয়ারের ক্যান খুলতে খুলতে প্রশ্ন করল, “কিছু হয়েছে নূরীর?”
“না।”
“তাহলে?”
শ্যামল সিগারেটের গোড়া অ্যাশট্রেতে সজোরে চেপে ধরে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। আশরাফের সামনে এসে বলল, “একটা প্রশ্নের উত্তর দে আমাকে আশরাফ। তুই আমি যুদ্ধ করেছি, করিনি?”
“করেছি,” আশরাফ চট করে বুঝে উঠতে পারেনা শ্যামলের হঠাৎ কী হয়েছে, “কেন? এই প্রশ্ন কেন করছিস তুই?”
“দেখ, তুই আমি খেতাব পেয়েছি, স্বাধীন দেশে চাকরি পেয়েছি, পাইনি?”
আশরাফ সহসা বুঝে যায় শ্যামল কেন এসব প্রশ্ন করছে। ওর চোয়াল শক্ত হয়ে যায় মুহূর্তেই।
“যুদ্ধে হারলে তোর কী হত? ফায়ারিং স্কোয়াড নয়তো নির্বাসন। আমার কী হত? নির্বাসন। স্বাধীনতা আমাদের জীবন দিয়েছে, সম্মান দিয়েছে, একটা ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়েছে যেটা ভাঙিয়ে খাচ্ছি আমরা…”
“শ্যামল! কী বলছিস তুই এসব?”
“না, আমাকে বলতে দে। হ্যাঁ, আমরা কিছুর জন্য যুদ্ধ করিনি। আমরা লড়াই করেছি। কিন্তু চিত্রা, চিত্রার কী দোষ? মাসের পর মাস ওকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে পাকি বাঞ্চোতের দল। এরপর স্বাধীনতা এলো, বাঙ্কার থেকে উদ্ধার করা হল ওকে- অর্ধনগ্ন, অর্ধমৃত। তখন সবাই ওকে ছি ছি করছিল। রাস্তার টোকাই পর্যন্ত ওকে বলছিল- বেবুশ্যা মাগী। কেন? এই যে তুই, এক পা খোঁড়া। কেউ তোকে বলেছে খোঁড়া হারামজাদা? তাহলে ওকে কেন বলছিল সবাই এসব?”
আশরাফ মাথা নাড়ল, “দেখ শ্যামল এসব বলে তো লাভ নেই…”
“না, থাম তুই। আরো আছে। ওকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ওই টাকায় বাড়ি তুলেছে ওর বাবা। কিন্তু সে বাড়িতে জায়গা হয়নি ওর।কেন? কারণ লোকে মন্দ বলবে, ওর বোনের বিয়ে হবে না। কেন? ওর সম্মানের বিনিময়ে পাওয়া বাড়িতে ওর কেন জায়গা হলো না?”
“উত্তরটা আমার কাছে চেয়ে কোনো লাভ আছে?”
আশরাফ নিজের অস্বস্তি ঢাকতে বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিতে যায়, শ্যামল এক থাবা মেরে ফেলে দেয় সেটা ওর হাত থেকে।
“হ্যাঁ, উত্তর দিবি তুই। উত্তর দিব আমি। কারণ আমরা ওর মত দুই লাখ নারীর ইজ্জত ক্যাশ করে স্বাধীনতা পেয়েছি। শহিদেরা শহিদ, আমরা গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা, আর ওরা? বীরাঙ্গনা। এর মানে সমাজ কী বোঝে? বোঝে একদল বোঝা, যারা মরতে পারেনি, গলায় দড়ি দিতে পারেনি। বেহায়ার মত চেহারা দেখিয়ে বেড়াচ্ছে সমাজের বুকে। বল তো, ওদের কী দোষ ছিল?”
শ্যামল হুহু করে কাঁদতে শুরু করল। আশরাফ ওকে জড়িয়ে ধরল, ওর মনে পড়ল ও না থাকলে জিনাতের কী হত যুদ্ধের শেষে।
সায়মার কপালে যা হয়েছে, ঠিক তা-ই হত।
“চিত্রা আমাকে বলেছে, সে আমাদের সবাইকে করুণা করে। করুণা করে আমাদের মেরুদণ্ড না থাকাকে। আমাকে সে চলে যেতে বলেছে, আশরাফ। বলেছে, ওর প্রশ্নের দিতে না পারলে ওর সামনে যেন না যাই আর।”
আশরাফ চুপ করে থাকে। ওর মুখে আর কোনো উত্তর যোগায় না।
যুদ্ধটা সব কেড়ে নিল, শুধু ওদের কষ্টগুলো নিয়ে গেল না।
(গল্পটি কয়েকটি সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে লিখিত।
চিত্রা চরিত্রটি নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইয়ের দুই বীরাঙ্গনা রীনা এবং তারা ব্যানার্জীর অনুপ্রেরণায় লিখিত।
নূরী চরিত্রটি রুনা লায়লা এবং ঝর্ণা চরিত্রটি চিত্রনায়িকা শবনমের ছায়া অবলম্বনে লিখিত। ১৯৭৪ সালে রুনা লায়না বাংলাদেশের ফিরে আসেন নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে। পাকিস্তানের চিত্রনায়িকা শবনমের পাসপোর্ট আটকে দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। তিনি দেশে ফিরে আসেন ১৯৯৯ সালে।
কমরেড ফয়েজ আহমদ ফয়েজের বাস্তব কিছু ঘটনা তুলে আনা হয়েছে এখানে। পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কবি ভুট্টো সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন ১৯৭২-১৯৭৪ সালে। গল্পে উল্লেখিত কবিতার পঙক্তিদুটো তিনি ১৯৭৪ সালে ঢাকায় এসে লিখেছিলেন। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যার বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন তিনি। জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ এর ইংরেজি চিত্রনাট্য তার লেখার কথা ছিল।
বেগম হামিদা বানুর চরিত্রটি পাঞ্জাবি কবি আহমদ সালিম ও পাকিস্তানি লেখিকা জেবুন্নেসা হামিদের ছায়ায় লিখিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলায় কারাগারে যেতে হয়েছিল তাকে। পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রখ্যাত নারীবাদী লেখিকা জেবুন্নেসা হামিদও বাঙালি ছিলেন। দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশে ফিরে আসার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না, স্বাধীনতার পক্ষেও তিনি কাজ করেন নি।
জিনাত মীরের ডায়েরির ধারণাটি নেয়া হয়েছে জাহিদা হিনার ছোটগল্প ‘রাখস-এ বিসমিল হ্যায়’ এর অবলম্বনে। সেখানে এক পাকিস্তানি গৃহবধূর বাংলাদেশে ঘটতে থাকা গণহত্যা সম্পর্কে তার পরিবারকে সচেতন করার চেষ্টার কথা উঠে এসেছে।)
Comments
Post a Comment