লকডাউন অকার্যকর - দায় কার?




(আর্টিকেলটি ২০২০ সালের ১৭ এপ্রিল লেখা হয়েছিল। ছাপা হয়েছিল ছয়শো একর নিউজ পোর্টালে)


লকডাউনের সিদ্ধান্ত জনগণ মানে না। 

মানুষকে কেন সরকারের কথা শোনানো যায় না? সরকার তো জনগণের জন্যই!

এ পর্যন্ত পড়ে অনেকেই মুখ টিপে হাসবেন।কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটু ভিন্ন। বিশ্বে গণতন্ত্র আছে এবং নিয়মিত নির্বাচন হয় এমন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনই সন্তোষজনক হয়নি। বিশেষত বিগত দুটি সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশকে কার্যত ওয়ান-পার্টি স্টেটে পরিণত করে ফেলেছে-এর প্রমাণ গণতান্ত্রিক দেশের র‍্যাঙ্কিঙে বাংলাদেশ ৮০ তম অবস্থানে।

বাংলাদেশে লক ডাউন কেন কাজ করে না,কেন জনসাধারণ সরকারের আদেশ মেনে নেয় না-এটা নিয়ে একটি কারণ আমাদের মাথায় আসে কি না,জানি না,তবে আমি মনে করি-এটা আসা উচিত। প্রকৃতপক্ষে,এটাই এই লক ডাউনের ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ। আর তা হলো- সরকার জনগণের কেউ না,তাই জনগণও সরকারের কথায় আস্থা খুঁজে পায় না।

অনেকেই ভাবছেন-মানুষ মূর্খ,মানুষ অসভ্য,মানুষ ‘আনকালচার্ড’ বর্বর; এজন্যই এদেশে লক-ডাউন কাজ করেনা। সরকারকে মিছেমিছি দোষ দিচ্ছি কেন? এই মহামারীর সময়েও রাজনীতি টানছি,এমনই পাষাণ আমি!


না,আপনি সমস্যাটি গভীরে তলিয়ে দেখেননি,তাই আপনার কাছে মনে হচ্ছে,আপাতদৃষ্টি মনে হচ্ছে,জনতাই নাটের গুরু! একটি জানোয়ারে পূর্ণ দেশে আপনি বাস করছেন। তাহলে আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করব,আপনি কেন আলাদা? যে কাজটা সরকার আপনাকে করাতে পারল,সেটা সবাইকে কেন করাতে পারবে না?

লক ডাউন কাজ না করার জন্য সর্বাংশে সরকার দায়ী না হলেও,এর চৌদ্দ আনা দায় সরকারের। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোই আপনাকে এটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবে। আমার উপর ভরসা রাখুন, বিফলে আমায় গালি দিয়েন জানোয়ার বলে।

 

লকডাউন কাজ না করার তিনটে প্রধান কারণঃ

১। জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ বাইরে বেরিয়ে আসে।

২। খাদ্যের সন্ধানে মানুষ বাইরে যাচ্ছে।

৩।খুশির ঠেলায় ঘুরতে মানুষ বাইরে যাচ্ছে।

 

এবার আমি বিশ্লেষণ করব তিনটি কারণই।

জীবিকার জন্য বাইরে যায় মূলত নিম্ন আয়ের মানুষেরা। কেন যেতে হবে তাদের? কারণ তারা যদি জীবিকার সন্ধানে না যায়,তাহলে তা না খেয়ে মারা যাবে। না খেয়ে মরাটা নিশ্চয়ই আপনারা সমর্থন করবেন না।

বাঙালি জাতির জিনে আছে ভাত না খেতে পাবার আদিম ভয়। আমাদের আদিপুরুষেরা নিত্য লড়াই করতেন ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের সাথে-সম্রাট অশোকের অহিংসার যুগেই হোক, শায়েস্তা খানের একটাকা আট মণ চাল পাবার দিনেই হোক, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণের আমলেই হোক অথবা স্বাধীন বাংলাদেশের শৈশবেই হোক। সোনার বাংলায় মানুষের প্রধান ভয় ভাতের আকাল। আমাদের সভ্যতার মুখোশটাও উদোম হয়ে যায় দুর্ভিক্ষের সময়।কাজেই আপনি কোনো ছুতোয় রাস্তায় রাস্তায় ত্রাণের খোঁজে ঘুরে বেড়ানো মানুষদের, রিকশাওয়ালাদের, গার্মেন্টস শ্রমিকদের কিংবা বাজারের দোকানিদের ঘরে রাখতে পারবেন না। বরং এদের দুর্দশায় ঘি ঢেলেছি আমরা সুশীলের দল,যারা দিব্যি ঘরে বসে আছি একমাসের বাজার সদাই করে আর ফেসবুকে গালি দিয়ে বেড়াচ্ছি।

 

সরকার এখানে কী করে পারত?

এখানে আগাগোড়া দায় সরকারের। ত্রাণকার্য কত ভালোভাবে চলছে সেটা জানার জন্য আমাদের তেমন কোনো বিশেষজ্ঞ ধরার দরকার নেই। কয়েকটা ফ্যাক্টস চেক করি,আসুন।

সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিদের বাসা থেকে এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে বস্তা চাল। দিনে বাংলাদেশিরা ভাত খাও মোটামুটি ৯২০ গ্রাম। প্রতি বস্তায় ৫০ কেজি চাল ধরে সে হিসেব করে দেখুন তো-কতজনের খোরাকি আছে এতে?

ভিজিএফ কার্ড নিয়ে অব্যবস্থাপনা নতুন কিছু নয়। শহরে প্রতি ঘরে গিয়ে খাদ্য দিয়ে আসা,কিংবা বিশেষ ব্যবস্থায় দরিদ্র ব্যক্তিদের খাবার দিয়ে আসা হলে,এ ঘটনা কি কমে আসত না? গার্মেন্টস নিয়ে কী নাটকটাই না হলো! তেলের বিছানায় ঘুমিয়ে ইতিহাস গড়ে ফেলছেন আরেকজন! ত্রাণ দেবার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না –মন্ত্রীর এমন উক্তির পরের খবরটাই ছিল ক্ষুধার জ্বালায় দশ বছরের শিশুর আত্মহত্যা। ত্রাণ চেয়ে ৩৩৩ তে কল করায় এক কৃষককে রক্তাক্ত করে চেয়ারম্যান,আরেকজন তো দরিদ্র কৃষককে মেরেই ফেলে ত্রাণ চাওয়ায়। বাড্ডায় ত্রাণের জন্য বিক্ষোভ হয়েছে,ঠাকুরগাঁওয়ে হয়েছে বিক্ষোভ,জামালপুরের ত্রাণের ট্রাক লুটে নিয়েছে জনতা, পথে ছিনতাই হচ্ছে খাদ্য।

একটা জোক শুনবেন? তথ্যমন্ত্রী বলেছেন যে খাদ্যের জন্য বিক্ষোভ নাকি রাজনৈতিক মদদপুষ্ট।

এইবার বলুন তো বুকে হাত দিয়ে বলুন তো-দোষটা কার?

 

দ্বিতীয় কারণ হলো খাদ্যের সন্ধানে বাইরে যাওয়া। এটা আমি গৌণ হিসেবেই ধরে নেব,কারণ এর মাঝে আছে কেবলই বাজারে যাওয়া বা মুদি দোকানে যাওয়া। যতই বাজার সদাই করে রাখুন,আপনাকে বাজারে যেতেই হবে-কারণ এই লক ডাউন কতদিন চলবে আপনার জানা নেই;তাছাড়া সামনেই রমযান মাস।

 

তৃতীয় এবং শেষ কারণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ শুধু শুধু বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এবার আপনি আমাকে খুব করে বাগে পাবেন,কারণ আপাতদৃষ্টিতে মানুষেরই দোষ। কিন্তু না,তলিয়ে দেখুন তো।

আপনার খুব সম্মানের একজন মানুষ,প্রভাবশালী জনদরদী কোনো নেতা,যাকে আপনি চেনেন,যার সাথে আপনি পাড়ার দোকানে চা পান করেন,এমন কোনো জনপ্রতিনিধির অনুরোধ আপনি ফেলতে পারবেন না। কারণ,উনি কেবল একজন নেতাই নন,উনি আপনার অংশ। শত শত সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ তিনি। উনার কথা আপনি যতই বর্বর হন,ফেলতে পারবেন না।

সন্দেহ হচ্ছে? ১৯৫৪ এর নির্বাচনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নাম লিখে দশ টাকার নোট মুড়ে ব্যালট পেপারের সাথে ভোটবক্সে ফেলেছিল আমাদের তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষের দল। মুক্তিযুদ্ধের কথা আর না-ই আনলাম।

জনসাধারণের সাথে জনপ্রতিনিধিদের এই দূরত্ব কেন?

প্রথমেই আপনাকে বের করতে হবে,জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন পদ্ধতিতে কোথায় সমস্যা আছে। দেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না,এটা ধ্রুবতারার মত সত্য কথা। শেষ যেবার এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল,তখন আমি হাফপ্যান্ট পরতাম। এবং এই ভোটারবিহীন,বিতর্কিত নির্বাচন মানুষের মনে সরকারের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি করেছে। এখন এর বিষাক্ত ফল দেখুন হাতেনাতে! বাংলাদেশের মানুষের মাঝে আছে গণতন্ত্রের প্রতি সহজাত আগ্রহ এবং এটা বিনষ্টের ফলাফল কখনোই ভালো হবে না। উন্নয়নের ললিপপ বেশিদিন মুখে রাখা যায় না।

গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বাররা টাকা ঢেলে নির্বাচন করেন। ছক্কা ছাইফুরের মত জনগণের চাদায় ভোটে বিজয়ী হওয়া সম্ভব না আর এখন। জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা কোথায়?

এমপি নির্বাচিত হন যারা,তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়!

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়ী ৮২% এমপির অর্থের পরিমাণ এক কোটি টাকার বেশি,৩২% এমপির ৫ কোটি টাকার বেশি। এটা শুধুই প্রদর্শিত অর্থ,কালো টাকার কথা আমরা না-ই বা বলি।

বাংলাদেশের মাত্র ০.০৬% মানুষের হাতে আছে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ। যে সংসদের ৮২% মানুষ প্রতিনিধিত্ব করেন দেশের মাত্র ০.০৬% মানুষের- তাদের কথা আর কী বলা যায়?

সংসদের ৬১.৭% এমপি ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীরা জনসাধারণের চিন্তা কতটুকু করবেন,সেটা ভালোমতই জানা যায় তাদের কাজকর্মে।

আরেকটা সমস্যা আছে এখানে। বাংলাদেশে উন্নয়ন আর জনপ্রতিনিধিত্ব সমার্থক।কিন্তু আসলেই কি তাই?

উন্নয়নের জন্য বছরে একজন এমপি পান তিন কোটি টাকা। এছাড়াও বিভিন প্রজেক্ট তো আছেই।এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের সাথে তৈরি হয় এক স্বার্থের দ্বন্দ্ব। স্থানীয় সরকার আর কেন্দ্রীয় সরকারের মাঝে রয়েছে দূরত্ব,সমন্বয়হীনতা। বাংলাদেশে সব সিদ্ধান্তই আসে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে,গণতন্ত্রায়নের জন্য এটা ভয়ানক ক্ষতিকর।

পার্লামেন্ট পাওয়ার ইনডেক্সে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্কোর ০.৫৯- খুব বেশি নয় কিন্তু!

 

মিডিয়া সেন্সরশিপ বা সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং আমাদের জনগণের কাছে একটা নেতিবাচক অর্থ পৌঁছে দেয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গুঁটি সরকার খুব বেশি খেলে-গুজব। গুজবের জুজুর ভয় দেখিয়ে সরকার মানুষকে কী মেসেজ দিতে চায়,তা মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়।কিন্তু এর ফলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কোথায় ঠেকে,তা আপনি করোনা শেষে একদিন বাজারে গিয়ে যাচাই করে নেবেন। বিনাবাক্যে সরকারের কথা মেনে নেবে-এমন মানুষ বিরল। গুজব শব্দটি সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকে কেবল প্রশ্নবিদ্ধই করেনি,এটা সরকারের প্রতি সৃষ্টি করে বিরাগ। আর এটা আমার মত নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে লাঠিপেটা খাওয়া বা কোটা আন্দোলনে টিয়ারশেল খাওয়া আমার ভাইবোনদের ভালোমতই জানা আছে।

করোনা নিয়ে বাংলাদেশে সচেতনতা তৈরি করতে সরকার প্রথমেই ব্যর্থ হয়েছে। অনেক বড় বড় ফাঁকা বুলি ছোঁড়া হয়েছে সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে, আসলেই যখন করোনা এলো দেশে,তখন একেবারে নগ্ন হয়ে গেল আমাদের সামনে। ডাক্তারদের ধমক দেয়া হলো, বাগাম্বর করা হলো বিদেশের ডাক্তার আনার। ভণ্ড হুজুরের আর ওয়াজেইনদের দল বিভ্রান্তি ছড়ালেন করোনা নিয়ে,সরকার চেয়ে চেয়ে দেখল। করোনা নাকি গরমে বাঁচে না, কেবল রুগ্ন বৃদ্ধরা আক্রান্ত হয় এই রোগে গুজব ছড়ালো- সরকার, গুজবের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকারী সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ এই গুজব সামাল দিতে।অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত নজির দেখাচ্ছে সরকার। এর বড় প্রমাণ আমি নিজে।

করোনায় বাংলাদেশে যেদিন প্রথম আসে,সেদিনও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম- গরমে করোনা ছড়াবে না। আমি শিক্ষিত হয়েই যদি এভাবে বিভ্রান্ত হতে পারি,দেশের ২৯% অশিক্ষিত মানুষের কী অবস্থা হত-বলুন তো? আমি সরকারকে দোষ দেব না কেন?

মানুষ যদি করোনাকে সিরিয়াসলি না নেয়,তবে এর দায় কার,আপনিই বলুন?

 

জনগণের ওপর দোষ ঢালাওভাবে দেবেন না,প্লিজ। আপনি,আমি সচেতন বলেই,প্রিভিলেইজড বলেই এমনটা ভাবতে পারি। দেশের জনগণ যদি অশিক্ষিত,মূর্খ হয়,দেশের সরকারের কিন্তু গৌরব বাড়ে না। দেশের মানুষ যদি গুজবে কান দেয়,তবে সরকারের গৌরব বাড়ে না। সরকারের সমালোচনা করি,কারণ এটা ওর প্রাপ্য। মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে সরকারের গৌরব বাড়ে না।

দেশে ছদ্মবেশী ফিউডালিজম চলছে। সংসদ সদস্যরা লর্ড, চেয়ারম্যান-মেম্বার জোতদার আর জনগ্ণ প্রজা। 

 

সরকার চেনা যায় দুর্দিনে,সুদিনে না। আপনিই ঠিক করুন,আপনি চোখ বুজে থাকবেন,না প্রশ্ন করবেন।

 


 

Comments